ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাবার মরদেহ গ্রহণে অনিচ্ছা ছেলের — সমাজের বিবেক নাড়া দেয়া এক হৃদয়বিদারক ঘটনা

লিটন হোসাইন জিহাদ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর হাসপাতালের নিঃসঙ্গ এক করিডোরে নিথর পড়ে ছিল এক পিতার মরদেহ। ৬০ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইব্রাহিম—একজন মানুষ, যিনি জীবনভর চড়াই-উতরাই পার করে হয়তো একটু ভালোবাসা, একটু স্বীকৃতির আশায় বেঁচে ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে তার প্রাপ্তি শুধু নিঃসঙ্গতা আর প্রত্যাখ্যান। সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা মরদেহ গ্রহণে প্রকাশ করলেন অনিচ্ছা। এক পিতার জন্য এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে?
মৃত ইব্রাহিমের জীবনের গল্পটি যেন একটি চলমান ট্র্যাজেডির রূপরেখা। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরের ফইল্লাতলি বাজারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি হিন্দু পরিবারে। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তার নাম রাখেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ধর্ম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়তো ছিল আত্মিক উপলব্ধি থেকে, কিন্তু এই পরিবর্তন তাকে সমাজে করে তোলে আরো একা।

যুবক বয়সে চট্টগ্রাম ছেড়ে দেন ইব্রাহিম। ঘুরেছেন নানা এলাকা, খুঁজেছেন জীবিকার পথ। এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কাদেরপুল, মহিষকার এলাকায় গড়ে তোলেন সংসার। জন্ম হয় এক পুত্র সন্তানের। কিন্তু সেই সংসারও ছিল স্বস্তির নয়। স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বাড়ে, সন্তানও হয় দূরবর্তী, শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় এমন নির্মম পরিণতিতে—যেখানে পিতা মারা যাওয়ার পরেও সন্তান বলছে, “আমি মরদেহ গ্রহণ করবো না।”
এই হৃদয়বিদারক ঘটনার শেষ পরিণতি ছিল আরেক মানবিক উদাহরণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাতিঘর’-এর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আজহার উদ্দিন এগিয়ে আসেন। মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেলে তার দাফন সম্পন্ন করেন তারা। এক নিঃস্ব পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দায়িত্ব পালন করেন সম্পূর্ণ অচেনা কিছু মানুষ — সমাজের সেই বাতিঘরেরা, যাদের উপস্থিতি আজও প্রমাণ করে, মানবতা মরে যায়নি সম্পূর্ণ।
এই ঘটনা কেবল ইব্রাহিমের একক জীবনের গল্প নয়, এটি আমাদের সময়ের এক নির্মম আয়না। যেখানে ধর্মান্তরিত হওয়া, ভিন্নপথে হাঁটা কিংবা সামাজিক নিঃসঙ্গতা একটি মানুষকে জীবদ্দশায় শুধু নয়, মৃত্যুর পরেও একাকী করে তোলে। সন্তান যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন প্রশ্ন জাগে — রক্তের সম্পর্ক কি এতটাই ঠুনকো?

একজন মানুষের জীবনের শেষ সময়ে এমন পরিত্যাগ, এমন অবহেলা শুধু একটি পরিবার নয়, সমগ্র সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়। মৃত্যুর পর সম্মান পাওয়ার অধিকার কি তারও থাকে না, যিনি জীবনে সব হারিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন একটু ভালোবাসার আশায়?
আজ ইব্রাহিম আমাদের সামনে রেখে গেলেন এক প্রশ্নচিহ্ন — আমরা কী সত্যিই এতটাই ব্যস্ত, এতটাই আত্মকেন্দ্রিক, যে নিজের পিতা-মাতার মরদেহকেও অস্বীকার করতে পারি?
‘বাতিঘর’ নামক সংগঠনের নীরব এই কর্মযজ্ঞ আমাদের চোখে জল এনে দেয়, আবার অন্তরে আশা জাগায় — এখনো কিছু মানুষ আছেন, যারা পরের শবযাত্রাতেও শামিল হন নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়।
Responses