অনলাইন ডেস্ক: বাউল কবি মোহাম্মদ মাতু মিয়া কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুর নামক গ্রামে ১৯০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদুল মমিন ভূঁইয়া। কবি বাল্যকালেই পিতাকে হারিয়ে চাচা আবদুল হেলিম ভূঁইয়ার স্নেহে লালিত পালিত হন। সে সময়ে সাম্প্রদায়িক বৈরী দৃষ্টির শিকার হয়ে কবি তৃতীয় শ্রেণির বেশি লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে একদিন স্কুল থেকে বিতাড়িত হন।
বাল্যকাল থেকে তিনি কথায় কথায় পদ্য লেখা ও গীত বাদ্য প্রিয় হয়ে উঠেন। কৈশোরে পদার্পন করতেই এক পিরের মুরিদ হন। লিখেছেন অনেক গান। প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকটি গানের বই। তার ‘গানের মালা’ নামক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন- গানের তালে কে যেন আমায় নাচায়। মনে পড়ে আমার পিরের কথা। পির সাহেব একদা আমাকে মানা করলেন গান গাইতে। আমি গান গাইলে নাকি নেংটা পাগল হয়ে যাব। তখন আমি বয়সে যুবক, আমি গান গাইতে চাই, কিন্তু গায়েবি পির সাহেবের নিষেধ আমাকে মানতেই হয়। তাই গান গাওয়ার ইচ্ছা দমিয়ে গান লেখার কাজে মজে গেলাম। গানের রাজ্যে ডুবে দেখলাম, গান বিদ্যা মহাবিদ্যা। এই বিদ্যায় মানুষের মনের মরিচা দূর করতে পারে। তিনি লিখেছেন-
স্নান করিলে নদীর জলে গা মাজিলে সাবান দিয়া। সাফ করিলে চামড়ার ময়লা মনের ময়লা কই থুইয়া।
তবে পরবর্তীকালে আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি ভাষা তিনি বেশ ভালই জানতেন। উর্দু- হিন্দি ভাষায় তার বেশ কিছু গান-গজল রয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে গানের আসরেই তার বেশির ভাগ সময় কেটে যেত। সংসার জীবনে কোন পুত্র সন্তান ছিল না। বিভিন্ন আসরে তিনি বাদ্য যনত্ব ছাড়া স্বরচিত গান গাইতেন আর স্বরচিত কবিতা পাঠ বা আবৃত্তি করতেন। তার গান রচনার প্রতিভা ছিল অসাধারন। সুফি সাধনার সকল দিকই তার গানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
পড় পয়লা বিস্মিল্লাহ্ বিস্মিল্লাহ বন্দনা আল্লার নূর মোহাম্মদ সাল্লোল্লাহ্ পড় পয়লা বিসমিল্লাহ্।
বয়োবৃদ্ধ শুভ্রকেশ ও দীর্ঘদেহী সৌম্য কাণ্ড এই বাউল লোক কবি এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন। চারণকবি মোহাম্মদ মাতু মিয়া ভারত-বাংলাদেশের বেশ অনেক অঞ্চল ঘুরে গান ও কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন অগণিত বাংলার মানুষকে। ৬০-এর দশকে কবি তার স্ত্রী-কন্যা আত্মীয় স্বজন সকলকে ছেড়ে চলে যান ঢাকার পুরাতন শহর দয়াগঞ্জে। সেখানে তার ছোট ভাই আফতাব উদ্দিন আহম্মদ সাবান কারখানার একটি কক্ষে নিলেন আশ্রয়। ১৯৬৮ সালের কথা। পরিচয় হলো ওস্তাদ আমান উল্লাহ খান সাহেবের সঙ্গে। একে একে বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী সরদার আলাউদ্দিন আহম্মেদ এর সঙ্গে। তৎকালীন পত্রিকা দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈকি পাক জমহুরিয়াত ইত্যাদি পত্রিকায় তার সাক্ষাৎকার ও সংক্ষিপ্ত জীবনতথ্য প্রকাশিত হয়। পরিচয় হয় রেডিও পাকিস্তানের পরিচালক আশফাকুর রহমান, টেলিভিশনের জনাব মোস্তফা মনোয়ার এবং বি.এন.আর এর পরিচালক ড. হাসান জামানের সঙ্গে।। বি.এন.আর তার প্রথম গানের বই প্রকাশ করেন। পরিচয় হয় সংবাদের শ্রী রনেশ দাসগুপ্ত, দৈনিক পাস্তিানের সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব সাহেবের সঙ্গে। স্বাধীনতা উত্তর এম.এ. গফুর নয়নের সহায়তায় কথা শিল্পী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে
সপ্তাহকাল ব্যাপী ঢাকা পল্টন ময়দানে গণ-মুক্তি আন্দোলনের বিজয় ঘোষণা ও গণশিল্পীদের এক বিশাল অনুষ্ঠানে মোহাম্মত মাতু মিয়া তার স্বরচিত গান ও কবিতা গেয়ে ও পাঠ করে একই আসরে শ্রেষ্ঠ ‘পল্লি বাউল কবির’ সেতারের জয়মাল্যে ভূষিত হন। কবি এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। ফলে অভাব-অনটন তাকে তার সারাজীবনের সাথী করে নিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে একটি গ্রন্থ প্রকাশের আশায় ঢাকার অলি গলি রাজপথে কত পথ যে পাড়ি দিয়েছেন তার শেষ নেই। এরপরও বলতে হয় তিনি ছিলেন একজন স্বার্থক বাউল সাধক লোক কবি। নিম্নে তাঁর একটি গান প্রদত্ত হলো: বাউলা দেশের আউলা কথা ভাও কইরা নাও বাও
নৌকা মাথায় লইয়া মাঝি
পাতলা বাইয়া যাও।
কাটলে মাথা থাকে যেথা
না কাটিলে মরন সেথা শূন্যলতা কয়না কথা মানুষ হইতে দাও।
মরায় গিলে জেন্ত মানুষ
মরার নাইরে দোষ ধর্মজালের বেড়ায় সাইড়া মন হারাইলে হুশ।
মাতু মিয়ার লাউয়া খানি যেমন একটা তেলের খানি বিনা হাতে দিয়া তালি
বাউল মোক্তার উদ্দিন
ভাঙ্গা ঢোল বাজাও।
ছবি ও তথ্য-
প্রিন্স রফিক খান
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত “বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা কিশোরগন্জ।