ডিয়েগো ম্যারাডোনার সতীর্থ হয়ে একসময় আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে লড়েছিলেন। সেই আর্জেন্টাইন এবার কলম্বিয়ার হয়ে লড়বেন আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে। কোপা আমেরিকার ফাইনালের আগে এমনই এক সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে কলম্বিয়ার কোচ এবং আর্জেন্টিনার সাবেক ফুটবলার নেস্তর লরেঞ্জো।
কলম্বিয়ার বর্তমান দলটা কয়েক বছর আগেও ছিল একেবারে ছন্নছাড়া। সর্বশেষ কাতার বিশ্বকাপে জায়গাই মেলেনি দলটির। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সেই দলকে এবার কোপার ফাইনালে টেনে তুলেছেন লরেঞ্জো। গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলকে রুখে দেয়ার পর সেমিফাইনালে উরুগুয়ের মতো হট ফেভারিটকে হারিয়েছে তারা।
২০২২ সালে যখন কলম্বিয়ার দায়িত্ব নেন লরেঞ্জো, তখন অনেক সমর্থকই বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি। মূলত দেশীয় কাউকে কোচ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তারা। তাই কলম্বিয়ার কিংবদন্তি ফুটবলার কার্লোস ভালদেরামাকে বাদ দিয়ে যখন অপরিচিত মুখ লরেঞ্জোকে আনা হলো তখন দেশজুড়ে একটা অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল। তবে সেই অপরিচিত লরেঞ্জোই এবার অসাধ্য সাধন করে দেখালেন।
২০২২ বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়া কলম্বিয়া সর্বশেষ ২৮ আন্তর্জাতিক ম্যাচের কোনটিতেই হারেনি। এবারের কোপায়ও কোনো ম্যাচ হারেননি হামেস রদ্রিগেজরা। সবাইকে টেক্কা দিয়ে কলম্বিয়া উঠে গেছে ফাইনালের মঞ্চে। এসব পরিবর্তনে ফুটবলারদের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি লরেঞ্জোর অবদানও চোখে পড়ার মতো।
২০১৪ বিশ্বকাপে চমক দেখানো হামেস রদ্রিগেজ তো প্রায় হারিয়েই গিয়েছিলেন। কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর তাকে ফেরানোর উদ্যোগ নেন লরেঞ্জো। এবারের কোপায় রদ্রিগেজ নিজেকে কিভাবে ফিরিয়েছেন, সেটা তো এখন সবার জানা। কিন্তু তাকে ফেরাতে গিয়ে যে রোষের মুখে পড়তে হয়েছে লরেঞ্জোকে সেটা অনেকেরই অজানা।
লরেঞ্জোর রদ্রিগেজকে ফেরানোর খবরে পুরো কলম্বিয়া জুড়ে একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি এই আর্জেন্টাইন। নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলা রদ্রিগেজকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে গেছেন শুরু থেকেই। কাতারের লিগ থেকে সরে এসে প্রতিযোগিতামূলক লিগে খেলার পরামর্শ দেন। সেখান থেকেই রদ্রিগেজের নিজেকে ফিরে পাওয়ার শুরু।
কোচের পরামর্শে আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়ে কাতারের লিগ ছেড়ে গ্রিসের ক্লাব অলিম্পিয়াকোসে খেলা শুরু করেন রদ্রিগেজ। সেখান থেকে আসেন ব্রাজিলের সাও পাওলোতে। তবে এই ক্লাবে তেমন একটা সুযোগ পেতেন না একসময়ের তারকা ফুটবলার। লরেঞ্জো তখন ভালোকিছুর আশ্বাস দেন রদ্রিগেজকে। সেই আশ্বাস যে এই ফরোয়ার্ডকে কতটা বদলে দিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এবারের পুরো আসরে।
রদ্রিগেজকে কেন এত মরিয়া হয়ে চাইছিলেন লরেঞ্জো, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এবারের কোপায়। মূলত মাঝমাঠ অটুট রাখতে ৩৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডকে খুব বেশি দরকার ছিল লরেঞ্জোর। আর তাই একজন গভীর চিন্তক ও ট্যাকটিশিয়ান হিসেবে রদ্রিগেজকে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।
এবারের কোপায় কলম্বিয়ার মূল শক্তি ছিল আগ্রাসী ফুটবল। গতি আর শক্তির প্রয়োগ করে আক্রমণে গিয়ে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেয়ার কৌশল নিয়ে খেলেছে দলটি। মাঠের একটি কোনাও ফাঁকা ছেড়ে দেয় ন
কলম্বিয়ার খেলোয়াড়েরা। জায়গা সংকুচিত করে এবং মুহুর্মুহু প্রেসিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়েন তারা। আর এসব কৌশলের মূল মাথা লরেঞ্জো।
ফাইনালে লরেঞ্জোর সামনে আর্জেন্টিনার বাধা। মাঠের ফুটবলের বাধার চেয়েও বড় বাধা আবেগের। আর্জেন্টাইন তারকা লিওনেল মেসি এবং দলটির কোচ লিওনেল স্কালোনিদের একসময়ের গুরু ছিলেন যে তিনি। তাই তাদের বিপক্ষে ভিন্ন ডাগআউটে থেকে লড়াই করাটা একটু কঠিনই হতে পারে লরেঞ্জোর জন্য।
পেকারম্যানের সহকারী হিসেবে ২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের কোচিং স্টাফ ছিলেন লরেঞ্জো। ওই বিশ্বকাপে খেলেছিলেন লিওনেল মেসি এবং লিওনেল স্কালোনি। এছাড়া আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়েও কাজ করেছেন তিনি। তাই জানা আছে দলটির নাড়ি-নক্ষত্র। এখন অদম্য আর্জেন্টিনাকে থামাতে লরেঞ্জো আর্জেন্টিনার ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ হয়ে ওঠেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়।