ভালবাসার পরমরূপ: চল্লিশ বছরের অন্ধত্ব

জয় এবং লীলা একে অপরকে প্রথম দেখা করেছিল একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে। জয়ের সুদর্শন এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব লীলাকে আকৃষ্ট করেছিল, আর লীলার অনিন্দ্যসুন্দর চেহারা এবং মিষ্টি স্বভাব জয়ের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেছিল। কিছু দিনের মধ্যেই তারা একে অপরের প্রতি প্রেমে পড়ে,তারপর নিয়ম করে দেখা,কথা বলা হয়। কোনো একদিন কথা না হলে কেউ থাকতে পারে না। অনেক বাধা বিপত্তির পর দুজনে  বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

বিয়ের পর জয় এবং লীলা একটি সুখী জীবন যাপন করতে লাগল। ঘর আলো করে আসলো এক ফুটফুটে সন্তান । তাদের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে একে অপরের প্রতি তারা পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। বিবাহের কয়েক বছর পার হওয়ার পরও কারো প্রতি এতোটুকু ভালোবাসা কমেনি বরং দিন দিন বাড়ছে। বই পড়া জয়ের খুব প্রিয় , সারা দিন অফিস করে রাত জেগে জেগে বই পড়ে। লীলা কফি বানিয়ে স্বামীর পাশে বসে বসে শুনে। এমনকি একদিনের জন্যও সে বিরক্ত হযনি। বরং স্বামীকে উৎসাহিত করতো। জীবনে কখনো জয়ের প্রতি সে বিরক্ত হয়নি। এমন বউ পেয়ে জয় বন্ধুদের সাথে অনেক গোৗরব করতো বউকে নিয়ে।

প্রতিদিন সকালে লীলা তার স্বামীর জন্য নাস্তা তৈরি করত, আর জয় তার স্ত্রীকে নানা উপহার দিয়ে খুশি করত। তারা একসাথে সারা জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিল।

কিন্তু তাদের সুখের জীবনে হঠাৎ করে অন্ধকার নেমে করোনা মহামারি। তখন এমন রোগে লীলা আক্রান্ত হয় যাতে তার চেহেরা আর চামড়া নষ্ট হতে থাকে।   এই রোগে আক্রান্ত হলে চামড়ার স্বাভাবিক রূপ হারিয়ে যায় এবং এক ধরনের কুৎসিত দাগ দেখা দেয়। একদিন লীলা বুঝতে পারল যে তার শরীরেও এই রোগের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। সে জানত যে শীঘ্রই তার সৌন্দর্য হারাবে এবং তার চেহারা কুৎসিত হয়ে যাবে।

ঠিক সেই দিনই জয় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক ভয়াবহ এক্সিডেন্টে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় সে তার দৃষ্টিশক্তি হারায় এবং পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। লীলা তার স্বামীর এই অবস্থায় খুবই ভেঙ্গে পড়ে, কিন্তু সে তার স্বামীকে সমর্থন এবং সেবা করার প্রতিজ্ঞা করে। তাদের সংসার আবার নতুনভাবে শুরু হয়, তবে এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।

জয় এবং লীলার সংসার চলতে থাকে, কিন্তু এইবার লীলা প্রতিদিনই তার চামড়ার রোগের কারণে কুৎসিত হতে থাকে। লীলা ভেবেছিল তার স্বামী তাকে দেখতে পাচ্ছে না এবং তার কুৎসিত চেহারা তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, জয় অন্ধ ছিল না। সে সব কিছুই দেখতে পেত, কিন্তু সে তার স্ত্রীকে সুখী এবং নির্ভার রাখার জন্য অন্ধত্বের অভিনয় করেছিল।

জয় প্রতিদিন লীলাকে আগের মতোই ভালোবাসা দিয়েছে। সে কখনোই লীলাকে বুঝতে দেয়নি যে তার চেহারার পরিবর্তন তার জন্য কোন সমস্যা নয়। লীলা প্রতিদিন তার স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করত, এবং তাদের সংসার সুখে এবং শান্তিতে চলতে থাকে। চল্লিশ বছর পর, লীলা বৃদ্ধা হয়ে মারা যায়। তার মৃত্যুতে জয় অত্যন্ত দুঃখ পেল, কিন্তু সে জানত তার ভালোবাসা তাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না।

লীলা যখন মারা গেল, তখন জয় তাকে কবর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে একজন ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় যাচ্ছ?” জয় উত্তর দিল, “আমি সেই বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি যেখানে আমার স্ত্রী এত বছর আমার সাথে সংসার করেছে।” প্রশ্নকারী অবাক হয়ে বলল, “তুমি কিভাবে একা একা বাড়ি ফিরবে! তুমি তো অন্ধ!” জয় মৃদু হেসে বলল, “আমি আসলে অন্ধ নই। আমি সবকিছুই দেখতে পাই। আমি আমার স্ত্রীর জন্য অন্ধত্বের অভিনয় করেছি, যাতে সে নিজেকে কখনো কুৎসিত না ভাবে।”