ছেলের লাশেও গুলি চালাচ্ছে পুলিশ, আসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন বাবা

মোঃ ফারদিন হাসান দিপ্তঃ দিনটি ১৮ জুলাই  ২০২৪ বৃহস্পতিবার। কোটা সংস্কারের দাবিতে নরসিংদীর জেলখানার মোড়ে চলছে সাধারন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। আন্দোলনের এক পর্যায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। চলছে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলি।

এসময় পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটের আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবম শ্রেণিপড়ুয়া তাহমিদ ভূঁইয়া তামিম (১৫)। তার লাশ স্ট্রেচারে রেখে স্লোগান দিচ্ছিলেন আন্দোলনকারীরা। সে সময় আবার গুলি চালায় পুলিশ। সেই গুলি তাহমিদের লাশেও লাগে। ১০০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে তাহমিদের বাবা রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া অসহায়ের মতো দেখেছেন সে দৃশ্য।

নিহত তাহমিদ নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের শিক্ষার্থী ছিল। পল্লিচিকিৎসক বাবা ও গৃহিণী মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিল তাহমিদ। ১৩ ও ৩ বছর বয়সী দুটি বোন রয়েছে তাহমিদের।

তাহমিদদের বাড়ি ঘটনাস্থল (জেলাখানার মোড়) থেকে ৩০০ গজ দূরে, নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের নন্দীপাড়া গ্রামে। গুলিবৃদ্ধ তাহমিদকে পাশেরই ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। পরে শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল থেকে স্ট্রেচারে করে স্লোগান দিতে দিতে ঘটনাস্থল জেলখানার মোড়ে নিয়ে আসে লাশ। এ সময় লাশ সামনে রেখে স্লোগান দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। আবার তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় পুলিশ। তখন সেখানে উপস্থিত হন তাহমিদের বাবা রফিকুল ইসলাম। তিনি দেখেন, ছেলের লাশে আবারও গুলি লাগল। ছেলের মৃত্যুতে ওই দিনের পর থেকেই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন তাহমিদের বাবা।

তাহমিদের স্বজনেরা জানান, ঘটনার দিন পরিবারের সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছেন। বিশ্রামের জন্য বিছানায় শুয়ে তাহমিদ ও তার ছোট বোন লিনাত (১৩) মুঠোফোন নিয়ে খেলছিল। একপর্যায়ে তাহমিদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় রান্নাঘরে কাজ করছিলেন মা। পাশের ঘরেই ঘুমাচ্ছিলেন বাবা।

তাহমিদ ঘর থেকে বেরিয়ে সড়কে উঠতেই তাহমিদকে বাসায় না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন।

See also  নরসিংদী কারাগার থেকে লুট হওয়া ৪৫ অস্ত্র উদ্ধার, এক জঙ্গি গ্রেফতার

এদিকে তাহমিদ জেলখানার মোড়ে গিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে যায়। সে সময় পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল। ঘটনাস্থলের ঠিক কোন স্থানে তাহমিদ পুলিশের রাবার বুলেটে বিদ্ধ হয়, তা সঠিক দেখা যায়নি।

স্ট্রেচারে করে ঘটনাস্থলে লাশ নিয়ে আসা হলে তাহমিদের বাবা দেখেন ছেলের লাশে আবারও গুলি লাগল। রফিকুল চিৎকার করতে থাকলে আন্দোলনকারীরা তাঁকে মসজিদের ভেতরে টেনে নিয়ে যান। গোলাগুলি কিছুটা কমলে শিক্ষার্থীদের সহায়তায় তাহমিদের লাশ নিয়ে বাড়িতে ফেরেন রফিকুল। ছেলের বিদ্যালয় ও স্থানীয় ঈদগাহে দুই দফা জানাজা শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়াই চিনিশপুর কবরস্থানে ওই রাতেই দাফন করা হয় লাশ।

১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ এন এম মিজানুর রহমান জানান, ‘রাবার বুলেটে বিদ্ধ তাহমিদকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে এনেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাকে মৃত ঘোষণা করার পরপরই উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা হাসপাতালে ভাঙচুর চালান। আমরা চেয়েছিলাম, তার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠাতে। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে আমরা সেটা পারিনি।’

তাহমিদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না প্রতিবেশী ও এলাকার লোকজন। তাঁদের ভাষ্য, ১৫ বছর বয়সী তাহমিদ সচেতনভাবে আন্দোলনে যায়নি। বাড়িতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তার দুই ফুফাতো ভাইও সেদিন আন্দোলনে যাননি। সে কীভাবে সেখানে গেল, এটাই আশ্চর্যের! শুধু কৌতূহল থেকে সেখানে গিয়েই এমন পরিণতি হলো তাঁর। হয়তো পরিচিতজনদের পেয়ে তাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।

রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া কাছে লাশের ময়নাতদন্তের বিষয়ে জানতে টাইলে তিনি জানান, ‘লাশের ময়নাতদন্ত করার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে আমাকে বলা হয়েছিল; কিন্তু রাজি হইনি। পুলিশ সবার সামনেই গুলি করে ছেলেকে মেরেছে, ময়নাতদন্ত করে আর কী হবে? ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না।’