গন্তব্যহীন ভ্রমণ ; রাবেয়া জাহান

সি এন জি ভ্রমণ সুলেখার ভালই লাগে। এমন অপ্রত্যাশিত আর উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ মাঝে মধ্যে খুব রোমাঞ্চকর মনে হয়। আসলে একটা সময়ের পর মানুষ অনেক বেশি হিসেবি হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে মনে হয় নিঃশ্বাসটা ও বুঝি হিসেব করে নিচ্ছি। কিন্তু, মন তো এমন হিসেবের বেড়াজালে আটকে থাকার জিনিস নয়।
তাই, অন্যের ক্ষতি করা ছাড়া, মাঝে মধ্যে মনের কিছু নিরর্থক দাবি পূরণ করা হয়তো তেমন দূষের কিছু না। সুলেখা এইসব বুঝাপড়া নিজের সাথেই করছিলো।
প্রতিটি মানুষই হয়তো নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণের জন্য কতো কি যুক্তি দাঁড় করায়। আবার, কিছু মানুষ এইসব যুক্তির ন্যায় অন্যায় গবেষণায় কতো না সময় খরচ করে।
সুলেখা, সুশৃঙ্খল এবং মার্জিত স্বভাবের নারী, এমনটা সবাই বলে৷ আর তাই সুলেখা আজ তার নিয়ম ভাঙার সিদ্ধান্তকে বৈধতা দেওয়ার অনেক যুক্তি চিন্তা করছে, শুধু মাত্র নিজের সাথে সমঝোতা করতে।
শহর থেকে বের হওয়ার পর সি এন জি অনেক স্পিডে চলছিলো। এক ঝলকেই মাঠ ঘাট, বাড়ি ঘর, গাছপালা সব কিছু মনে ধারণ করছিলো সুলেখা। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে সুলেখা বরাবরই এক অনন্ত সুখ খুঁজে পায়। প্রতিটি বাড়ির টিনের চাল বেয়ে লক লক করে বেড়ে উঠা শিম গাছগুলো দেখে কেমন আনমনে আনন্দে হেসে উঠলো সুলেখা। মনে হলো, পৃথিবীটা কতো সুন্দর, সুখী হওয়া কতো সহজ!
এরই মাঝে পৌছে গেলো বিশ্বরোড। সবাই ভাড়া দিচ্ছিলো, সুলেখাও তখন হ্যান্ড ব্যাগ থেকে টাকা খুলার জন্য চেইন টানলো। হঠাৎ ই মনে পড়লো, তার টাকার ছোট ব্যাগটি কোনো কারণে আজ সে বাসায় রেখে এসেছে। পরে আর হ্যান্ড ব্যাগে ডুকায়নি।
বুকের মধ্যে কাপুনি শুরু হলো। একে তো কাউকে না বলে অকারণে বিশ্বরোড এলো, এখন আবার টাকা নেই।
ড্রাইভার সবার থেকে যেভাবে একেক টাকা হিসেব করে নিচ্ছিলো, ড্রাইভারের কাছ থেকে কোনো প্রকার পজিটিভ কিছু আশা করতে পারছে না সুলেখা। আজ অবদি সুলেখা তার বাবা মায়ের কাছ থেকও খুব প্রয়োজন ছাড়া টাকা চায়নি। কেমন করে কোনো যাত্রীর কাছে সে টাকা চাইবে।
এদিকে সি এন জি চালকের অসহায় চেহারাটা এখন অনেক বেশি বাণিজ্যিক মনে হচ্ছে। সুলেখা যখন বললো সে টাকা আনতে ভুলে গেছে, সি এন জি চালক তখন বলে উঠলো, ” এইসব বলে লাভ নাই, আমার টাকা আমারে দেন।”
সুলেখার চোখ পানিতে ছল ছল হয়ে উঠলো। অনেক কষ্ট করে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে সুলেখা, বার বার মনকে বুঝাচ্ছে, কোনো ভাবেই চোখের পানি ফেলা যাবে না।
সি এন জি চালক অনেক উচ্চ স্বরে কথা বলতে লাগলো। কিন্তু সুলেখা কোনো কথা বলতে পারছে না৷ তার হাত, পা, ঠোঁট অনবরত কাঁপছে। সে জানে, কথা বললেই তার কান্না চলে আসবে।
আল্লাহর অশেষ রহমতে, সুলেখার পাশের সীটের মহিলাটি সুলেখার প্রতি সদয় হলো। মহিলা ড্রাইভারকে বললো, ” অতো চিল্লাইতেছো কেরে? সীটটাতো খালি ই থাকতো। সময়ে মানুষের বিপদ বুঝতে হয়।,এই নাও তোমার ভাড়া”।
আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানায়, সুলেখা। মহিলাটিকে বিশেষ কিছু বলার শক্তি ছিলো না তার দেহে। কেমন অবশ হয়ে আসছিলো, পুরো দেহ। মহিলাটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে, বিকাশ নম্বরটি চাইলো।মহিলাটিও খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে, সুলেখা অপ্রত্যাশিত এক বিপদে পড়েছে। তাইতো সে নিজ থেকেই বললো, আপনার কাছে তো টাকা নেই, আপনি একশত টাকা রাখেন৷ পরে বিকাশ করে পাঠিয়ে দিয়েন। সুলেখা টাকাটা নিয়ে, মাথা নাড়লো।
সি এন জি চলে গেলো, লোকজন ও চলে গেলো। সুলেখা স্বাভাবিক হতে পারছে না। সুলেখা নিজেই খুব অবাক হচ্ছে তার চরিত্রের এই ভঙ্গুর অবস্থা দেখে। এর মানে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার যোগ্যতা তার মাঝে গড়ে উঠেনি। কতো মানুষকে শেখায় সে, কলেজের শিক্ষক। অথচ, আজ নিজে কেমন অবুঝের মতো আচরণ করছে।
আসলে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার শিক্ষা পাঠ্য পুস্তকে নেই, পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়।
বস্তুত, মানুষ জানে না, একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনো নাজুক মুহূর্তে সে কেমন আচরণ করবে। তাইতো বাস্তব অভিজ্ঞতা যার যত রয়েছে, টিকে থাকার যোগ্যতা তার তত বেশি।
সুলেখার এখন চা খাওয়ার একেবারেই মন নেই। তারপর ও মনের বিরুদ্ধেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে একটা চায়ের দোকানে গেলো৷ আশে পাশে আরো কয়েকটা চায়ের দোকান আছে। ঐ সব দোকানগুলোতে বিভিন্ন বয়সের লোকেরা কি সব উলটা পাল্টা কথা বলছে আর অশ্লীল ভাবে হাসছে। সুলেখা এখন কিছুটা ভীত। ভাবছে, কোনো রকম চা খেয়েই বিদায় নিবে।
সুলেখার অস্থিরতা দোকানদার হয়তো বুঝতে পেরেছে। তাই জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো, ” আফা আপনার বাড়ি কই? চা খাইতে এই রাতে একলাই আইছেন”। সুলেখার চা অর্ধেক শেষ হয়েছে, বুকের ভেতর তার কম্পন শুরু হয়েছে। কোনো রকম নিজেকে সামলে বললো,
” বিল কতো হলো”?
সুলেখার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে সব জায়গায় সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এই যুগে মানুষের সরলতা আর নমনীয়তা হয়তো বেমানান।

 

 

Posted in Uncategorized