ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ও পাড়া মহল্লায় পাহাড়া দিচ্ছেন মুসলমান

আবুল হাসনাত অপু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া:  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খ্রীষ্টিয়ান ও সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকাসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেন স্থানীয় আলেম উলামা মাদ্রাসার ছাত্র, বিএনপি জামায়াতে ইসলামী নেতা কর্মী এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের স্থানীয় বাসিন্দারা। ধর্মীয় উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি ও লুটপাট থেকে রক্ষা পেতে গত ০৫ আগস্ট সোমবার রাত থেকে তাঁরা লাঠি, বাঁশি ও টর্চলাইট নিয়ে রাতভর পাহাড়া দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশত্যাগের খবরে সোমবার দুপুরের পর থেকে জেলা সদরসহ সর্বত্র জাতীয় পতাকা হাতে শিশু কিশোর কিশোরী তরুণ তরুণী নারী পুরুষ আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয় মিছিলকারীদের মধ্যে। এর পাশাপাশি চলে সড়কে থাকা ১৫ আগস্টের গেইট ভাঙ্গা, ব্যানার ফেস্টুন ছিঁড়ে এবং বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করে আসবাব বাহিরে এনে আগুন জ্বালিয়ে ভষ্মীভূত করার তৎপরতা। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মম নির্যাতনে ছাত্রলীগকে সহায়তা করার দায়ে পুলিশের উপর ক্ষুব্ধ থাকার কারণে বিকেলে মিছিলকারীদের একটি অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার চারটি ভবনে আগুনে পোড়ানোর পাশাপাশি ব্যাপক লুটপাট চালায়। যা পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে দেখা যায়। হামলার সময় ছাত্রজনতাকে নিবৃত্ত করতে ও আত্মরক্ষার্থে থানায় উপস্থিত স্বল্প সংখ্যক পুলিশ সদস্য এলোপাথারি রাবার বুলেট এবং তাজা গুলি ছুঁড়ে। খবর পেয়ে তাদের রক্ষায় এগিয়ে যাওয়া সেনা বাহিনীর দুইজন সদস্য আহত হন। রাবার বুলেট ও তাজা গুলিতে আটজন আহত হন। আহতদেরকে চিকিৎসার জন্য রাস্তায় উপস্থিত জনতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঐ সময় কয়েকটি অস্ত্রও লুট হয় বলে পুলিশ জানায়। এ ছাড়া কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ এলাকায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাড়ি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী চৌধুরী, আখাউড়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাকজিল খলিফা, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন শোভন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা আফরিন জুঁইসহ বিভিন্ন নেতা কর্মীদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
সোমবার রাত থেকে পরদিন মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সদর থানায় চলে লুটপাট। এসব ঘটনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হামলা থেকে রক্ষা পেতে সেনা বাহিনী, জেলা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইউনুছিয়া মাদ্রাসার নেতৃবৃন্দ পৃথক বৈঠক করে হিন্দু অধ্যুষিত পাড়া মহল্লায় ও মন্দিরে রাত জেগে পাহাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর পর থেকে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে জেলার আলেম সমাজ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীসহ স্থানীয় মুসলিম জনতা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা নিয়মিত রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মতবিনিময় করেন। বুধবার দুপুরে জেলা ছাত্রদলের সদস্যসচিব সমীর চক্রবর্তী ও জেলা তরুণ দলের আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন নেতা-কর্মীদের নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে যান। তাঁরা বলেন, ‘আমরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন মহল্লায় পাহারা দিচ্ছি। এ ছাড়া হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে পাহারা জোরদার করা হয়েছে।’
মঙ্গলবার সকালে আখাউড়া পৌর এলাকার মহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় বৈঠক করেন আলেম-ওলামা ও ইমাম পরিষদের নেতারা। বৈঠকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির ও বাড়িঘর রক্ষায় করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। মাওলানা আসাদ আল হাবীবের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন মুফতি মো. আসাদুজ্জামান, কাজী মো. মাঈনুদ্দিন, মাওলানা মো. হেলাল, মুফতি ইব্রাহিম, বিল্লাল আহমেদ, হাফেজ রাসেল, মো. বায়েজিদ প্রমুখ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পক্ষে সেখানে বক্তব্য দেন উপজেলা পূজা উদ্?যাপন পরিষদের সদস্যসচিব বিশ্বজিৎ পাল। বিশ্বজিৎ পাল বলেন, আখাউড়ার বিভিন্ন মসজিদে নামাজের বয়ানে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর রক্ষায় সচেতনতার কথা বলা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর হতে পৌর এলাকার রাধামাধব আখড়ায় হেফাজতের নেতৃত্বে পাহারা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির নেতা কর্মী, আলেম সমাজ ও স্থানীয় লোকজন রাত জেগে হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে পাহাড়া দিচ্ছেন।
গত ১১ আগস্ট রোববার দিবাগত রাতে জেলা সদরের পূর্ব পাইকপাড়া সামাজিক সম্প্রীতি পরিষদের উদ্যোগে মাতৃভান্ডার মিষ্টির দোকানের মালিক মালু পালের বাড়ীতে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সামাজিক সম্প্রীতি পরিষদের সভাপতি ঠিকাদার আবু জাহিদ এর সভাপতিত্বে এবং সাবেক পৌর কাউন্সিলর মোঃ আহসান উল্লাহ হাসানের উপস্থাপনায় আয়োজিত সমাবেশে হিন্দু অধ্যুসিত এই এলাকায় মন্দির ও বাড়ী ঘর পাহাড়া দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রস্তাবনা উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন ডা. পি.বি. রায় সুপ্রিয়, সম্প্রীতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, এম.এ বাশার, সাংবাদিক আবুল হাসনাত অপু, মালু পাল, মাসুদ রানা, রাশেদ, রুবেল প্রমুখ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সার্বিক আলোচনার পর এলাকা ভাগ করে নৈশ কালীন পাহাড়া জোড়দার করার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার খালেদ মাহবুব শ্যামল ভিডিও কলে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় এবং এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান। পাশাপাশি তিনি এ সমাবেশ আয়োজনের জন্য উপস্থিত হিন্দু মুসলিম সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

See also  তল্লাশি করে দুই প্রাইভেটকার থেকে গাঁজা উদ্ধার করলো ছাত্ররা