লিটন হোসাইন জিহাদ: বাংলাদেশ বর্তমানে এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বৈষম্য বিরোধি ছাত্র আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের গঠনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে অসন্তোষ, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা লক্ষণীয়। সুবিধাবাদীরা ধর্মীয় সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে।
সাম্প্রতিক বৈষম্য বিরোধি ছাত্র আন্দোলন মূলত ছিল কোটা সংস্কারের আন্দোলন। এই আন্দোলনে সরকারের একরোখা নীতির কারণে আবু সাঈদ, মুগ্ধ সহ দেশের প্রায় সারে তিনশত মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দুর্নীতি, ন্যায়বিচারের অভাব, এবং সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার প্রতিফলন হিসেবে সর্বাত্বক সাট ডাউন ঘোষনা করে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। এই আন্দোলন দেশের যুবসমাজের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা এবং অসন্তোষের সঞ্চার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকায় এই আন্দোলন দ্রুতই জাতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত হয় এবং সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়। তাতেও সরকার নমনীয় না হওয়ায় নয় দফা দাবি থেকে ছাত্ররা সরকার পতনের এক দফা দাবি নিয়ে মার্চ টু ঢাকা শুরু করে।
ছাত্র আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনা। বিজয় মেতে উঠে রাজপথ। পুলিশ বাহিনীর প্রতি চরম রাহনুমা ও ক্ষোভে থানায় আক্রমন করা শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাতে করে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা ছাড়ার পর প্রশাসনে একটি শূন্যতা তৈরি হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও তাদের অভিজ্ঞতার অভাব এবং পুলিশ বাহিনীর কর্মবিরতীর কারণে আইনশৃংখলার অবনতি দেখা দেয়।
সরকারের পতনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, চাঁদাবাজি, এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশাসনের ক্ষমতার শূন্যতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের স্বার্থে ব্যস্ত থাকার কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং শান্তি বিঘ্নিত করছে।
দেশের এ অস্থিরতা অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি এবং বাজারে পণ্যের ঘাটতি জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে। দেশের রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এই পরিস্থিতি দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবে প্রভাব ফেলছে এবং দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ছে।
এ সমস্যা সমাধানে করণীয়:
1. অন্তবর্তীকালীন সরকারের শক্তিশালীকরণ:
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে আরও কার্যকরী করতে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন একটি সর্বদলীয় সমঝোতা, যেখানে সব রাজনৈতিক দল সরকারের কার্যক্রমে সহায়তা করবে এবং দেশে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে একত্রে কাজ করবে।
2. আইন-শৃঙ্খলার পুনর্বহাল:
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমন এবং রাজনৈতিক সহিংসতা রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
3. দ্রুত নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর:
রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে একটি নিরপেক্ষ এবং অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে, যা জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটাবে। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার প্রতিষ্ঠা হলে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
4. অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা:
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। কালোবাজারি ও মজুদদারি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
5. সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা:
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তাদের অধিকার সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রশাসন এবং সুশীল সমাজের সহযোগিতা প্রয়োজন।
6. দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কার:
বাংলাদেশের বর্তমান সংকটের মূল কারণ দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠন, স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়া, এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক পরিবর্তন আনা জরুরি।
7. জনগণের অংশগ্রহণ ও সুশাসন:
দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে একটি কার্যকর সরকার গঠন করতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান সংকট একটি চরম উত্তেজনাপূর্ণ এবং জটিল অবস্থার প্রতিফলন। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সমঝোতা, এবং সুশাসন। একটি সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক এবং সুশাসিত বাংলাদেশ গড়তে হলে বর্তমান সংকটকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এর সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।