মানুষের মতো দেখতে রোবট হয়ে উঠছে বুদ্ধিমান

মানুষের মতো দেখতে রোবট এখন আর কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতেই সীমাবদ্ধ নেই। মানুষের মতো রোবট তৈরি করছে বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান। নানা কাজে এসব রোবটের ব্যবহারও শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান বোস্টন ডায়নামিকস, টেসলা ও ওপেন এআই মানবসদৃশ উন্নত রোবট তৈরিতে কাজ করছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও রোবট তৈরিতে সাহায্য করছে। এসব রোবট মানুষের মতো চলাফেরা করতে সক্ষম। পাশাপাশি নানা তত্পরতা ও দক্ষতার দিক থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে। রোবটে এই দক্ষতা বাড়াচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ।

গবেষকেরা বলেন, রোবটের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) যোগ করা গেলে এগুলো সত্যিকার অর্থেই দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। তবে এ জন্য রোবটের মস্তিষ্কে এআই প্রয়োগ করতে হবে বা এআই সক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্কযুক্ত রোবট তৈরি করতে হবে। এ ধরনের রোবট তৈরি করা গেলে সেগুলোর সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের পদ্ধতি উন্নত হাতে পারে। রোবট মস্তিষ্কযুক্ত মানবসদৃশ রোবট তৈরি হলে তা বাজারে ‘আইফোন মোমেন্ট’ তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, বাজারে এ ধরনের রোবটের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হতে পারে, যা আইফোন বাজারে আসার সময় হয়েছিল।

রোবটকে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন করে তুলতে হলে এতে বিশেষ বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে। এ ছাড়া এ রোবটকে নানা কিছু শেখার যোগ্য করে তুলতে হবে। ওপেনএআইয়ের তৈরি চ্যাটজিপিটির মতো এআই চ্যাটবট তৈরির পেছনে থাকা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (এলএলএম) প্রযুক্তি দেখিয়েছে যে এগুলো শিখতে সক্ষম। এলএলএমকে যে পরিমাণ তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখান থেকে সঠিক তথ্য বেছে উপস্থাপন করতে পারে এগুলো। এগুলোকে তাই ‘এমবডিড ইন্টেলিজেন্স’ বা মূর্ত বুদ্ধিমত্তার চাবিকাঠি বলা হয়।

‘এমবডিড ইন্টেলিজেন্স’ শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াগুলোর একীভূতকরণকে বোঝায়। আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করে, অনেকটা সে রকম প্রক্রিয়া এটি। এমবডিড ইন্টেলিজেন্সের লক্ষ্য হচ্ছে, রোবটকে মানুষের মতো একইভাবে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম করা।

ধারণাটি নির্ভর করে লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ও ভিজ্যুয়াল এআই সিস্টেমের ওপর। ভিজ্যুয়াল এআই সিস্টেম ভিডিও ও ছবিতে থাকা বস্তু সম্পর্কে কম্পিউটারকে ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে। এটি পর্যবেক্ষক ও বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে যান্ত্রিক যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং রোবটকে বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে তাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটতে পারে।

গবেষকেরা বলেন, এলএলএম একা রোবটের মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করবে না। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে গুগলের তৈরি এআই সিস্টেম ‘পাম-ই’কে উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। এর প্রকৌশলীরা একে রোবট সেন্সর ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এতে এআই সিস্টেমটি রোবটকে সবকিছু কার্যকরভাবে শিখতে সাহায্য করে।

এআই খাত দ্রুত এগিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে নতুন এআই মডেল উন্মুক্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পাম-ইর মতো উন্নত প্রযুক্তিকে যদি মানবসৃদশ রোবটের সঙ্গে অন্যান্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তাহলে খুব বেশি প্রোগ্রামিং করা ছাড়াই এগুলো আমাদের পৃথিবী সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা নিতে পারবে।

কারখানা থেকে বাড়িতে

মানবসদৃশ রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্র বিশাল ও বৈচিত্র্যময়। এ ধরনের রোবট তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষ যেসব বিপজ্জনক ও কঠিন জায়গায় কাজ করতে পারে না, সেখানে এগুলোর ব্যবহার করা। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার তৈরি ভ্যালকিয়েরি রোবট। রোবটটি মহাকাশ অভিযানে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন কারখানায় মানবসদৃশ রোবট দেখা যাবে, যেগুলো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম হবে।

নির্ভুল এবং ধৈর্যের প্রয়োজন এমন কাজ করে উত্পাদন ও সরবরাহব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাতে পারে টেসলার অপটিমাসের মতো রোবটগুলো। কয়েক মাস আগে ঘোষণা দেওয়া বোস্টন ডায়নামিকসের অ্যাটলাস ২–এর মতো রোবট ইতিমধ্যে কারখানায় কিছু ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছে। এই রোবট ভারী যন্ত্রাংশ তুলতে ও সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালোহা রোবট চীনা খাবার তৈরি করছে। শিল্প খাতে ব্যবহারসহ মানবসদৃশ নানা ধরনের রোবট ঘরের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

এর বাইরে নানা পেশাদার কাজ যেমন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন, জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে এ ধরনের রোবট।

গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন যে মানবসদৃশ এ ধরনের রোবটের কারিগরি সম্ভাবনা অনস্বীকার্য হলেও এ ধরনের পণ্যের বাজারের কার্যকারিতা অনিশ্চিত। খরচ, নির্ভরযোগ্যতা, জনসাধারণের উপলব্ধিসহ বেশ কয়েকটি কারণ তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও সাফল্যকে প্রভাবিত করবে।

নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোক্তার আস্থা ও ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনা করা হয়। তাই টেসলার অপটিমাসকে বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হলে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রমাণের পাশাপাশি বাস্তব সুবিধাগুলো দেখিয়ে আস্থা অর্জন করতে হবে।

মানবসদৃশ রোবটের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর নৈতিকতা। রোবট যেসব তথ্য সংগ্রহ করে, সেগুলো কারা নিয়ন্ত্রণ করছে, তা উদ্বেগ তৈরি করবে। এ ছাড়া রোবট ও মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যোগাযোগের তথ্যগুলো কার হাতে পড়ছে, তা দেখতে হবে। রোবট যাতে সহিংস হয়ে উঠতে না পারে, সে প্রশ্নও উঠবে। সামাজিক ঝুঁকি ও সাইবার নিরাপত্তার সমস্যার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আসবে।

মানবসদৃশ রোবটের ক্ষেত্রে উদ্বেগ যতই থাক, মনে রাখতে হবে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমান রোবট এখনো প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা থেকে দূরে রয়েছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্রে যেসব দৃশ্যকল্প দেখানো হয়, সেগুলো বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা এখনই নেই।

মানবসদৃশ রোবট তৈরির ক্ষেত্রে রোবটিকস, নীতিশাস্ত্র, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন পড়বে। নতুন প্রযুক্তি সামনে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ সৃষ্টি করবে, তা মোকাবিলায় দক্ষ মানবসম্পদের অন্তর্দৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

মানুষ এখন নতুন প্রযুক্তি সীমান্তের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। প্রযুক্তি দিয়ে কী করা সম্ভব, শুধু তা–ই নয়, আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যতের জন্য কী কী কাম্য, সেটাও বিবেচনা করা অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

দ্য কনভারশেসন, রিসার্চগেট অবলম্বনে