ভাষ্কর্য ভাঙার ইতিহাস: শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। ইতিহাস আবার ও প্রমাণ করে দিলো মানুষ যাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান দিতে গড়তে পারে, তাকে আবার অসম্মান দিয়ে ভাঙতে ও পারে।
২০০৩ সালে যখন মার্কিন ট্যাঙ্ক ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ঢুকে সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে, তখন চারদিকে আনন্দের পরিবেশ দেখা গিয়েছিল।
সাদ্দাম হোসেনের ১২ মিটার উঁচু এই মূর্তি ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে নির্মাণ করা হয়েছিল।
মার্কিন সেনারা সাদ্দাম হোসেনের মূর্তির গলায় লোহার শিকল জড়িয়ে এম৮৮ সাঁজোয়া যানের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। এরপর ভেঙে পড়ে ওই মূর্তি।
সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জড়ো হওয়া জনতা মূর্তির টুকরো সংগ্রহ করতে থাকেন। ভাঙা মূর্তির টুকরোতে জুতো দিয়ে আঘাত করতে করতে বাগদাদের রাস্তায় প্যারেড করতে দেখা যায় জনতাকে। এই দৃশ্য বিশ্বের সব টেলিভশন চ্যানেলে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতার অবসানের প্রতীক হিসাবে মনে করা হয়েছিল এই পুরো বিষয়টাকে।
এই ঘটনার সঙ্গে অনেকেই তুলনা করেছিলেন ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে বিপ্লবের প্রচেষ্টার যেখানে স্ট্যালিনের একটা মূর্তি ভাঙা হয়েছিল।
তারপর ভাঙা হয় গাদ্দাফির মূর্তি
এই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের সময়। ওই সময় ত্রিপোলির বাব আল-আজিজিয়া প্রাঙ্গণে ঢুকে তার মূর্তির মাথা ভেঙে ফেলার পর সেটা পদদলিত করার দৃশ্য ধরা পড়েছে।
অন্যদিকে,২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের খারকিভে প্রায় পাঁচ হাজার বিক্ষোভকারী ভ্লাদিমির লেনিনের একটা মূর্তি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে মাটিতে ফেলে দেয়
লেনিনের মূর্তি ভেঙে ভূলুণ্ঠিত করে দেওয়ার পর সেখানে জড়ো হওয়া জনতা মূর্তির টুকরোগুলো স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করতে শুরু করে। সেখানে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপরই শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রক্রিয়া।
ইথিওপিয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি
১৯৮৯ সালের নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর পতনের পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। বারেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে লেনিনের মূর্তি।
ঠিক একই চিত্র দেখা গিয়েছিল আলবেনিয়ায়। সেখানে ৪০ বছর ধরে ওই দেশ শাসন করা এনভার হোক্সার বেশ কয়েকটা মূর্তিও ভেঙে ফেলা হয়।
১৯৯১ সালে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভকে উৎখাতের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মস্কোর লুবিয়াঙ্কা স্কয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম গুপ্ত পুলিশ সংস্থা ‘চেকা’র প্রতিষ্ঠাতা ফেলিক্স জেরনস্কির মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়।
১৯৯১ সালের ২২ আগস্টের সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ লুবিয়াঙ্কা স্কয়ারে অবস্থিত কেজিবি ভবনের সামনে জড়ো হয়।
তারা জেরনস্কির মূর্তির গায়ে লিখে দেন ‘খুনি’। সেখানে উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা মূর্তির উপরে উঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে।
সেই সময় মস্কো সিটি কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান সের্গেই স্টানকেভিচ উপস্থিত জনতাকে জানান তিনি নিজেই মূর্তিটি অপসারণে নেতৃত্ব দেবেন।
এরপর ক্রেনের সাহায্যে সেখান থেকে ওই মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। সেই মূর্তির স্থান হয় ‘ফলেন মনুমেন্ট পার্কে’।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিউইয়র্কে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের একটা লোহার মূর্তিও ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সামিল আমেরিকানরা এই মূর্তিকে ব্রিটিশ অত্যাচারের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করতেন।
এই মূর্তি শুধুমাত্র ভেঙে ফেলাই হয়নি তারপর সেটা গলিয়ে ৪২০০০ বুলেটও বানানো হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে সেই বুলেটই ব্যবহার করা হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে।
মুসোলিনির মূর্তিরও একই পরিণতি হয়েছিলো।
১৯৪৫ সালে ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনির পতন হয়। সেই সময় তার মূর্তিরও একই পরিণতি দেখা গিয়েছিল।
তার ক্ষমতাচ্যুতির পর তার কিছু সমর্থক এবং তার বান্ধবী ক্লারা পিটাচিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একটা ভ্যানে করে তাদের মৃতদেহ মিলানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটা খুঁটি থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় তাদের দেহগুলো।
এরপর শুরু হয় মুসোলিনির মূর্তি ভাঙার প্রক্রিয়া। স্বৈরাচারের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হওয়া সমস্ত স্মারক, ভবন এবং মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক মাস ধরে চলেছিল এই একই প্রক্রিয়া।
সরানো হয় পঞ্চম জর্জের মূর্তি
১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দিল্লির অনেক জায়গায় ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্তা ব্যক্তিদের মূর্তি ছিল।
এই মূর্তিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং কিছু স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লিতে। উত্তর দিল্লির করোনেশন পার্কে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল সেই মূর্তিগুলো।
যে কয়টা মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে পঞ্চম জর্জের মূর্তি। ৭০ ফুট উঁচু ছিল এই মুর্তি।