উত্তরাঞ্চলে মোটা চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ৪০০-৫০০ টাকা। ত্রাণ বিতরণে পণ্যটির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। সংকট না থাকলেও প্রতিদিনই বাড়ছে চালের দাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ বন্যার কারণে ত্রাণ বিতরণে বিপুল পরিমাণ চালের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এজন্য চালের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুনাফাখোর একটি সিন্ডিকেট চালের মজুত গড়ে তুলেছে। এরাই এখন চালের কৃত্রিম সংকট দেখাচ্ছেন।
সিন্ডিকেটের কবলে চালের বাজার, দাম বাড়তি
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) বগুড়ার শেরপুরের স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই সপ্তাহ আগেও ৫০ কেজির বস্তা কাটারিভোগ চালের দাম ছিল ৩০০০ হাজার টাকা। এখন তা ২০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিআর২৯ জাতের ৫০ কেজির বস্তা চাল আগে ২৩০০-২৪০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৭০০-২৮০০ টাকায়। বিআর২৮ জাতের চালের আগে দাম ছিল ২৬০০-২৭০০ টাকা। বর্তমানে তার দাম হয়েছে ৩০০০ টাকা। এছাড়া সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ চালের দাম বাড়ার পেছনে অসাধু মিল মালিক ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা দায়ী। শেরপুরের পাইকারি ব্যবসায়ী রবিউল ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, সদ্য বোরো মৌসুম শেষ হয়েছে। তাই ধান-চালের সংকট নেই। বন্যা ও ত্রাণের অজুহাতে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিদিনই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ অটোরাইস মিল মালিকরা উত্তরাঞ্চলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে অটোরাইস মিলের সংখ্যা এখন পাঁচ শতাধিক। এছাড়াও সেমি অটো হাস্কিং মিলের সংখ্যা কমবেশি ৪০ হাজার। এসব মিলের উৎপাদিত চালের একটা অংশ অগ্রিম পেমেন্টে কিনে নেয় ২-৩টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে চালের বাজার স্বাভাবিক সরবরাহের কমবেশির ওপর মূল্য নির্ধারণ হয় না। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন এই সিন্ডিকেট সদস্যরা।
উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রতিবছর আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয় সোয়া ১ কোটি মেট্রিক টন চাল। এই অঞ্চলের চাহিদার মিটিয়েও আরও প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তুু এই উদ্বৃত্ত ধান কোথায় কীভাবে বিক্রি হয় সেই তথ্য মিলাররা কখনো প্রকাশ করেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সোয়া ২ কোটি মেট্রিক টন চালের চাহিদার বিপরীতে যে পরিমাণে ধান উৎপাদন হয়, তাতে অল্প পরিমাণ চাল ঘাটতি থাকে। এই ঘাটতিকে পুঁজি করেই সিন্ডিকেট সদস্যরা চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করেন কোনো ইস্যু পেলেই। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চালের মোকাম শেরপুর উপজেলা। এখানে আটটি অটোমেটিক রাইস মিল ও বেশ কয়েকজন আড়তদার রয়েছেন। তাদের গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রয়েছে কিন্তু তারা বিক্রি করছেন না। আবার বিক্রি করলেও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে চাল সরবরাহ করছেন। এছাড়া বড় বড় করপোরেট কোম্পানির গুদামগুলোতেও পর্যাপ্ত চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর ও ঢাকায়
বড় বড় ওয়্যারহাউজ রয়েছে। সেখানে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রয়েছে বলে একাধিক ব্যবসায়ী সূত্র জানিয়েছে।
শেরপুরে মজুদদার অটোমেটিক রাইসমিল, ওয়েস্টার্ন অটোমেটিক রাইসমিল, আলাল এগ্রো, শাকিল চাউল কল, সঞ্জয় সাহা, গৌর সাহা, প্রদীপ সাহা, বাছেদ চাল কল, মোখলেস এগ্রো, মির্জাপুর আলম চাউল ঘরসহ একাধিক ব্যবসায়ীর গোডাউনে হাজার হাজার বস্তা চাল মজুত রয়েছে বলে জানা গেছে।
শেরপুর উপজেলা ধান চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল হামিদ দাবি করেন, হঠাৎ করেই ধানের সংকট দেখা দিয়েছে। তাই ধানের দাম বেড়ে গেছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াই চালের দাম একটু বেড়েছে। এছাড়া বন্যার কারণে ত্রাণের জন্য চালের চাহিদাও বেড়ে যাওয়া দাম বাড়ার একটি কারণ।
নওগাঁয় মোটা চালের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪-৫ টাকা। পাইকারি বাজারে মোটা চালের প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ২০০ টাকা। তবে ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবস্তায় চালের দাম বেড়েছে ৩০০-৩৫০ টাকা। বন্যাকে কেন্দ্র করে মোটা ধানের দাম বৃদ্ধি ও ধানের আমদানি কমে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা ।
জেলার চালকল মালিকরা বলছেন, বন্যাকে কেন্দ্র করে নওগাঁয় চাল উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে কৃষকরা এসময় হাটবাজারে ধানের আমদানি কম করায় মোটা ধানেরই প্রতিমনে দাম বেড়েছে ৫০-১০০ টাকা। বর্তমানে প্রতিমণ মোটা স্বর্ণা ধান বিক্রি হচ্ছে ১৩০০-১৫০০ টাকায়। বর্তমানে জেলার খুচরা বাজারে প্রতিকেজিতে চার টাকা বেড়ে প্রতিকেজি স্বর্ণা ৫০-৫৫ টাকা ও হাইব্রিড ৪৫-৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে ।