অদম্য কলাগাছ  : গাজী তানভীর আহমদ

অদম্য কলাগাছ
গাজী তানভীর আহমদ

ধোয়া উড়ছে…
ধোয়া উড়ছে…
ধোয়া উড়ছে। আশপাশ আচ্ছন্ন হয়ে বহুতল ভবনের জানালার ফাঁকফোকর দিয়েও ঢুকছে ধোয়া। তিনজন ব্যক্তি অনেক আয়োজন করেই আজ আগুন দিয়েছে। তাও যদি বাঁচা যায়। আর যেন সহ্য হচ্ছে না। কেটেকুটে যাওয়ার দশ কি বারোদিন যেতে না যেতেই আবারো গজিয়ে ওঠে। একটা দুইটা কিংবা এক-দুদিক থেকে নয়; ডজনখানেক– কখনো আরও বেশি।

৩৯ মজুমদার হাউস, পুরানা পল্টনের সাততলার পশ্চিম পাশের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেই নিচের পরিত্যক্ত খালি জায়গাসহ বিশাল তিনতলা বিল্ডিংটা দেখা যায়। আশেপাশের কিছু জায়গা খালি পড়ে আছে, কিছু জায়গায় গাছগাছালি উঠেছে, আবার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিদিন কিছু গাড়িও পার্কিং করে রাখা হয়। কিন্তু প্রায় চার হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে বানানো তিনতলা বিল্ডিংটাতে দু’চারজন দারোয়ান ছাড়া আর কাউকেই তেমন দেখা যায় না। দেখা যায় না বলতে ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের আগ পর্যন্ত এই জায়গাটাতে বিশেষ তেমন কাউকেই আসা-যাওয়া করতে দেখা যায়নি। চাকরির সুবাদে মজুমদার হাউসে দীর্ঘদিনের আসা-যাওয়ায় এমনটা কখনো রবিনের চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ছে না।

রবিন অনেকটা ভাবুক প্রকৃতির। চাকরির পাশাপাশি টুকটাক লেখালেখি করে। প্রকৃতি খুব ভালো লাগে তার। তাই কাজের ফাঁকে একটু সুযোগ পেলেই জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। এই ব্যস্ত আর নাভিশ্বাসের ঢাকাতে যেন পরিত্যক্ত এই বিশাল বাড়িটি অনেকটাই আশীর্বাদের। উপর থেকে নিচে তাকাতেই সবুজ-সবুজ গন্ধ পাওয়া যায়। ছোট ছোট পাখিগুলোর এ-গাছ থেকে ও-গাছে ছোটছুটি করা, গর্ত থেকে মুখটা বের করে এদিক ওদিক তাকিয়েই পরপর কয়েকটা বেজির দ্রুত ছুটে যাওয়া, আবার কখনো স্থির দাড়িয়ে শিকারি খোঁজার চেষ্টা করা, আম কাঁঠালের দিনে বাউন্ডারিঘেষা গাছগুলোতে মুকুল আসা থেকে শুরু করে সময়ের সাথে সাথে ফুল ফলের সৌন্দর্য উপভোগ– প্রতিদিন এসব দেখতে পারাটা যেন ছিল পরম সৌভাগ্যের। বিশেষ করে ঢাকার মতো এমন একটি ব্যস্ত জায়গায় এ ধরনের পরিত্যক্ত বাড়ির কথা চিন্তাও করা যায় না। বিশেষত বাড়িটির পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় প্রায় দেড়শ বর্গফুট জায়গাজুড়ে কলা গাছের যে বাগটি গজিয়ে উঠেছে এবং এর কোনায়-গর্তে বেজিসহ  বিভিন্ন সরীসৃপ প্রাণীর যে অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে তা সত্যি অভিভূত হবার মতো দৃশ্য। রবিন অফিস চলাকালীন প্রতিদিন এই জায়গাটা দেখে দেখে গ্রামের সুবাস অনুভব করে। প্রাণজুড়ে মুগ্ধতার নিঃশ্বাস ফেলে।

বাড়িটির বাউন্ডারীর উপরে বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা–  ‘বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন।’ ধারণা করা যায় যে, এই বাড়িটির মালিকানা উক্ত সমিতির। তারা একেকজন শত-হাজার কোটি টাকার মালিক। বোধহয় এজন্যই এই জায়গাটিতে এতদিন নজর পড়েনি।

কিন্তু ২০২৪ এর শুরুর দিকে এসে একদল কর্মী কলাগাছের এই বাগটিসহ আশপাশের সব ধরনের গাছ-গাছালি কেটেকুটে পরিষ্কার করে দিয়েছে। সম্ভবত দিনটা ছিল শুক্রবার। পরদিন অফিসে এসে রবিন এই দৃশ্য দেখে ভিশন মন খারাপ করে। রবিন শুধু একা নয়; সেদিন ওর অফিসের অন্যান্য সহকর্মীরাও প্রকৃতির এই নিধনযজ্ঞে খুব কষ্ট পায়। কর্মীদের তোড়জোড় দেখে মনে হয়েছে এই পরিত্যক্ত জায়গাটিতে মালিকপক্ষ বহুতল ইমারত গড়ে তুলবে। একদিকে সভ্যতার নির্মাণ, আরেক দিকে প্রাণ-প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞ! বোধহয় এটাই বিধান, সময়ের মিশেল।

তারপর মাসখানেক যেতে না যেতেই কলাগাছের বাগটিতে অসংখ্য ধেম (চারা) গজিয়ে উঠেছে। দুই-তিন ফুট লম্বা হওয়ার আগেই কর্মীরা এসে সেগুলোর মাথা আবারও কুচিকুচি করে দিল। তারপর আবার গজালো…
ওরা আবারও কুচিকুচি করল!
তারপর আবার গজালো…
ওরা আবারও কুচিকুচি করল!
এভাবে পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে ৭-৮ বারের মত ওরা সামান্য কলাগাছ নিধনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করল। সবশেষে ওরা আশপাশ থেকে শুকনো পাতা, খড়, গাছের শুকনো ডালপালা জড়ো করে বিশাল অগ্নিকাণ্ডের সূচনা করল। তখন ধোয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন হয়ে গেলে একেকজন অট্টহাসিতে বলতে লাগল–
… ‘যা, শালা আর  উঠবো না।’
… ‘এমন পোড়া দিছি! দেখি আর কেমনে ওঠে!’
… ‘শালার কলাগাছ! আর কেমনে উঠস দেখমু…।’

এমন দৃশ্য আর কথোপকথনে রবিনের অন্তরাত্মা সেদিন বারবার কেঁদে উঠেছিল। মন বলছিল এই কলা গাছগুলো অদম্য। ওরা আবারো প্রাণশক্তি নিয়ে জেগে উঠবে। ওদের আশপাশে আগের মত আবারো ইঁদুর, বেজি, সরীসৃপেরা ছোট ছুটি করবে, মাথা গুঁজবে।

………………………………….
৩৯ মজুমদার হাউস, পুরানা পল্টন,  ঢাকা- ১০০০
মুঠোফোন : ০১৫৫৬  ৫৬২ ৬৩৩
২৮ আগস্ট ২০২৪