লিটন হোসাইন জিহাদ : বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পরে, বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষণীয় এবং বিতর্কিত বিষয় হলো জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব। যা নিয়ে ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া বির্তক তৈরি হয়েছে। জাতীয় সংগীত, যা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক, পরিবর্তনের বিষয়টি গভীর সংবেদনশীল এবং রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রস্তাবকে অনেকেই আত্মঘাতি উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি হতে পারে। তবে, এই প্রস্তাবের পেছনে কী ভাবনা কাজ করছে এবং কেন এই বিতর্ক এতটা উত্তাল, তা বুঝতে হলে আমাদের জাতীয় সংগীতের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের দিকে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা, যা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভূগোলের প্রতি গভীর ভালবাসার প্রতিফলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, একজন কবি এবং দার্শনিক, পূর্ববঙ্গের নওগাঁ জেলার পতিসরে তাঁর জমিদারী কাজ দেখাশোনা করার সময় এই গানটির অনুপ্রেরণা পান। একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, রবীন্দ্রনাথ একদিন একটি বাংলোতে বসে থাকার সময় এক বাউল গায়কের কণ্ঠে একটি গান শুনতে পান। সেই বাউল ছিলেন গগন হরকরা, যিনি গেয়েছিলেন, “আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে।” এই গানটি রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে স্পর্শ করে এবং তিনি এর থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে “আমার সোনার বাংলা” রচনা করেন।
এটি রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন, যেখানে তিনি বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জীবনের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগ প্রকাশ করেছেন। পদ্মার জলরাশি, ধানের শীষ, এবং বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই সংযোগই গানটিকে এতটা জীবন্ত এবং মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী করেছে। এই গানের মূল সুর এবং কথাগুলি বাংলার মাটি থেকেই এসেছে, যা বাংলাদেশের জনগণের আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। কলকাতায় জীবনযাপন করলে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই গানটি রচনা করতে পারতেন না, কারণ সেখানে বাংলার এই মাটির সুর এবং প্রকৃতির সঙ্গে এমন গভীর সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবিতে যে যুক্তিগুলো আনা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের জনগণের ধর্মীয় চেতনা এবং সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা। কিছু মহল থেকে দাবি করা হয়েছে যে, বর্তমান জাতীয় সংগীতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জনগণের আবেগ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং তা ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায় না। এই দাবি অনুযায়ী, নতুন জাতীয় সংগীত প্রণয়ন করতে হবে যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
তবে, এই প্রস্তাবের বিরোধিতায় বলা হয় যে, “আমার সোনার বাংলা” শুধু একটি গান নয়; এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত এই সংগীতটি দেশের জাতীয় ঐক্য ও ইতিহাসের অংশ। এই সংগীতটি স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের প্রতীক। এর পরিবর্তন শুধু একটি সংগীতের পরিবর্তন নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও পরিচয়ের সঙ্গে একটি বড় ধরনের আপোষ হবে। জাতীয় সংগীতের পরিবর্তনের প্রস্তাবনা রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পরিচয়ের ওপর আঘাত হানতে পারে।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে চলমান বিতর্কটি আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নিয়ে যায়: একটি জাতির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন গ্রহণ করা উচিত। অনেকেই মনে করেন যে, জাতীয় সংগীতে হাত দেওয়া উচিত নয়, কারণ এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করলে তা রাষ্ট্রের ঐক্য এবং জাতীয় চেতনার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সংগীত পরিবর্তন করলে জনগণের মধ্যে ঐক্য বা অভিন্নতার অনুভূতিতে ফাটল ধরতে পারে, বিশেষ করে যদি পরিবর্তনটি বিতর্কিত হয়। যেমন, নাইজেরিয়ায় সংগীত পরিবর্তনের সময় অনেক নাগরিক পরিবর্তন মেনে নিতে চাননি, যা জাতীয় বিভক্তি সৃষ্টি করেছিল।আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি দেশের পরিচয় তার জাতীয় সংগীতের সাথেও জড়িত। সংগীত পরিবর্তন করলে অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে পারে, বিশেষ করে যদি পরিবর্তনের পেছনে কোনো বিতর্কিত বা সেনসিটিভ কারণ থাকে।
সার্বিকভাবে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রশ্নটি শুধু সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত নয়; বরং এটি জাতীয় ঐক্য, ইতিহাস, এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার প্রস্তাব একটি গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যা জাতীয় চেতনা ও ঐক্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
লেখক: সাংবাদিক