মাজারে হামলা: সমাজে বিভাজন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র?

মাজারে হামলা: সমাজে বিভাজন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র?

লিটন হোসাইন জিহাদ: সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরপরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাজার ও দরবার শরীফে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা দেশজুড়ে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে হযরত সিলেট, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ আরও বেশ কিছু স্থানে এই হামলাগুলো লক্ষ্য করা গেছে। মাজার ভাঙচুরের এসব ঘটনা শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানেনি, বরং এটি সমাজের স্থিতিশীলতা, ঐতিহ্য, এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ওপরও চরম আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। মাজার বা দরবার শরীফ শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং তা দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং বহু শতাব্দীর ঐতিহ্যের প্রতীক, যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত।

উপমহাদেশে ইসলামের প্রথম রাজনৈতিক বিজয় ঘটে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু প্রদেশে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মাধ্যমে।  আর ভারত উপমহাদেশে ইসলামের আগমন মূলত দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হলেও এর প্রসার ও স্থায়িত্বে সুফি সাধক, বিশেষ করে ওলিদের (আধ্যাত্মিক নেতাদের) অবদান ছিল অনন্য। প্রথমদিকে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম প্রবেশ করে, তবে এর আধ্যাত্মিক প্রভাব বৃদ্ধি পায় সুফি সাধকদের প্রচেষ্টায়। মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক বিজয়ের পাশাপাশি, ওলিরা মানুষকে আধ্যাত্মিক পথে আকৃষ্ট করে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার করেন।তাদের মাঝে অন্যতম হলেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (র.), যিনি চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতবর্ষে আধ্যাত্মিকতার আলো ছড়িয়ে দেন।বাংলাদেশে হযরত শাহজালাল রা. ও হযরত শাহপারান রা. এবং তাদের অনুসারীরা আধ্যাত্মিক শক্তি ও শিক্ষা দ্বারা বহু মানুষকে ইসলামের পথে আনেন।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মাজার মুসলমানদের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, বিশেষ করে সুফিবাদের অনুসারীদের কাছে। এই পবিত্র স্থানগুলো আধ্যাত্মিক চর্চা এবং মানবতাবাদী শিক্ষার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। তাই এই ধরনের হামলা শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতি সাধন করে না, বরং একটি বিশেষ ধর্মীয় ভাবনার ওপর আঘাত হানে যা মানুষকে একত্রিত করে রেখেছে। ফলে, মাজারে হামলা শুধুমাত্র একটি অপরাধ নয়, এটি সমাজের একটি বৃহত্তর অংশকে তাদের আত্মিক ও মানসিক জগতে আঘাত করা এবং সামগ্রিকভাবে ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ঐক্যের ওপর হুমকি সৃষ্টি করা।

এই হামলাগুলো ধর্মপ্রাণ মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করেন, এই ধরনের হামলা মূলত সমাজকে বিভাজিত করার এবং ধর্মীয় সহিংসতার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ভঙ্গের একটি ষড়যন্ত্র। মাজার এবং দরবার শরীফে হামলা যারা করে তারা কেবল ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা প্রদর্শন করে সমাজের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করা। মাজারের আধ্যাত্মিকতা এবং ঐতিহ্যের সাথে যারা যুক্ত, তারা মনে করেন যে, এই ধরনের হামলা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবমাননা নয়, বরং এটি সমাজের মুল্যবোধ ও সহনশীলতার ওপর সরাসরি আক্রমণ।

দেশের বিভিন্ন আলেম ও তরিকত সংগঠনগুলো এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে। বিশেষত, তরিকত পরিষদ তাদের দাবির মধ্যে মাজারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে এবং মাজার ভাঙচুরকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। তারা মনে করে, যদি এই ধরনের ঘটনা অবিলম্বে বন্ধ করা না হয় এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা না হয়, তবে সমাজে আরো বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।

 

রাষ্ট্রের করণীয় হিসেবে, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। মাজার ও দরবার শরীফগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এবং এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে প্রশাসনের প্রতি দাবি উঠেছে, তারা যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এবং সমাজে পুনরায় শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি ও দ্রুত পদক্ষেপ না থাকলে সমাজে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি বাড়তে পারে, যা ধর্মীয় সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে।

সাধারণ মানুষেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই পরিস্থিতিতে। জনগণের উচিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্রান্ত প্রচার না করে, বরং শান্তি ও সংহতি বজায় রাখার জন্য প্রচারণা চালানো। মাজারে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পক্ষ থেকে মতামত উঠে আসছে, তবে এমন সময়ে শান্তি ও সহনশীলতার জন্য একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। বিভাজনের বদলে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া এখন জরুরি, যাতে অপপ্রচার বা সহিংসতার জায়গা না থাকে।

মাজারে হামলা একটি দেশব্যাপী সংকটের সূচনা হতে পারে, যদি না এ বিষয়ে সমাধান খোঁজা হয়।মাজারে হামলা শুধু ধর্মীয় সহিংসতা নয়, বরং সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে একটি ষড়যন্ত্রও হতে পারে। সরকারকে এসব ষড়যন্ত্রকারী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে, যারা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের দায়িত্ব হলো সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, মাজারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। রাষ্ট্রের কঠোর আইন প্রয়োগ এবং ছাত্রনেতাদের শান্তি ও সংহতির প্রচারই পারে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে।  সমাজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে রক্ষা করতে এই মুহূর্তে প্রয়োজন ঐক্য, দৃঢ়তা, এবং সচেতনতা।

লেখক: সাংবাদিক