লিটন হোসাইন জিহাদ: ড. মুহাম্মদ ইউনুস সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এই সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল থেকে জন্ম নেওয়া বিক্ষোভ, যা মূলত সরকারী চাকুরির কোটাব্যবস্থা নিয়ে শুরু হয়েছিল, অবশেষে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। ফলে দেশজুড়ে সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, এবং প্রায় হাজারের ও অধিক মানুষ প্রাণ হারায়, যার মধ্যে পুলিশও ছিল।
অর্ন্তবতীকালীন সরকারে ড. ইউনুসকে বেছে নেওয়া হয়েছে তার নিরপেক্ষ অবস্থান এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি তার অঙ্গীকারের কারণে। এই অন্তর্বর্তী সরকার মূলত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে, যেখানে ছাত্র আন্দোলনের দুইজন নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তবে, এই সরকারের টেকশই হওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বৈধতা নেই। তবে আদালত এক বিশেষ রায় দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধতা প্রদান করেছে
ড. ইউনুসের প্রথম লক্ষ্য হবে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ। তবে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং সহিংসতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকায় এই চ্যালেঞ্জ সহজ হবে না। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী সহিংসতার শিকার হওয়ায় তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং জনগণের সুরক্ষা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ হবে। এদিকে, শেখ হাসিনার পরিবার এবং আওয়ামী লীগ দলের নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা রাজনীতি থেকে পিছিয়ে যাবে না এবং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ে এসেছে, যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সহিংসতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকার কতটা টেকসই ও উন্নয়নমূলক হবে তা নির্ভর করছে কিভাবে এটি বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে এবং নতুন নির্বাচনের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তবে এমন পরিস্থিতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মোকাবিলা করতে হবে সরকারের প্রাজ্ঞ পরিকল্পনা ও বিচক্ষণতার সাথে।
কারণ বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সঠিক কাঠামো ও বৈধতার অনুপস্থিতি রয়েছে। ড. ইউনুস ও তার সহকর্মীদের উপর ব্যাপক জনমত থাকা সত্ত্বেও, সরকারী ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং বিশ্বাস অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থক ও নেতৃত্ব তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে। তাদের সমর্থন বা বিরোধিতার ওপরই অনেকাংশে ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে
এছাড়া, দেশের অর্থনীতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে হবে। সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং অব্যবস্থাপনার ফলে ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ক্ষতি হয়েছে। নতুন সরকারকে অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে হবে এবং জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই ক্ষেত্রে, নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরী বলে মনে করি।
১. রাজনৈতিক সংলাপ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে। সহিংসতা ও ভাঙচুরের পরিবর্তে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে, যাতে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকে।
২. সুশাসন ও জবাবদিহিতা: সরকারকে জবাবদিহিতামূলক কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য প্রশাসনকে দক্ষ ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করতে হবে। সরকারের প্রতিটি কাজকর্ম জনসাধারণের কাছে খোলাখুলি ও স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
৩. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার: অবিলম্বে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
৪. সামাজিক নিরাপত্তা: দেশের দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য একটি স্থিতিশীল সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করা এবং একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
৫. নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তুতি: সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সাথে কাজ করতে হবে এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সব রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ থাকে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ থাকে।
ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারে, তবে এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও একটি মডেল হিসেবে দাঁড়াবে।