ঘূর্ণিঝড়ের নাম রেখেছিলাম ‘তুমি

লিটন হোসাইন জিহাদ: আমার শহরে কোনো ঘূর্ণিঝড় ছিল না। ছিল না কোনো রক্তপাত, ছিল না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম বার্তা। শুধু তুমি এসেছিলে— নিঃশব্দে, নিরবধি, একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো।
তোমার আগমনের দিন আকাশ স্বচ্ছ ছিল, বাতাস নরম। কিন্তু তার মধ্যেই আমার চারপাশের সবকিছু অস্থির হয়ে উঠলো। ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ থেমে গেল, দেয়ালের ক্যালেন্ডার থেকে পাতাগুলো উড়ে গেল, আর আমি, আমি বুঝতে পারলাম— সময় যেন তোমার জন্য থেমে গেছে।
তুমি আমাকে ভালোবাসা শিখিয়েছিলে, তবে সেই ভালোবাসা ছিল এক কালো যাদুর মতো— যে যেই ছুঁয়েছে, সে ফিরে যেতে পারেনি নিজের ভিতরে।
আমি তখন বুঝিনি তুমি ঘূর্ণিঝড়, তুমি ধ্বংসের নামতা পড়তে পড়তে এসেছিলে, আমার বুকের ভিতর থেকে পৃথিবীর শেষ কবিতাটিও ছিঁড়ে নিয়ে যেতে।
তুমি চলে গেলে।
তুমি রেখে গেলে এক মৃত শহর, যেখানে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু ভাঙা প্রতিমা, কিছু নষ্ট গন্ধ, কিছু ফেলে যাওয়া চিঠি। তোমার চলে যাওয়ার পর আমি একে একে বুঝতে পারলাম— আমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো তোমার নামে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার আঙুল তোমার চুল খোঁজে, আমার চোখ তোমার মুখ খোঁজে, আর আমার ছায়া? সে তো তোমার ছায়ার সাথে আত্মহত্যা করেছে অনেক আগেই।
তখন আমি অভিশাপ দিলাম— তবে ভাষার মাধ্যমে নয়, আমি অভিশাপ লিখলাম বাতাসে, ঘুমহীন রাতের বিছানায়, শুকিয়ে যাওয়া কুয়োর পাড়ে, আর সেই আয়নায়— যেখানে তুমি একদিন তোমাকে সুন্দর বলেছিলে।
আমি বললাম— “তোমার প্রতিটি সকাল হোক লাল, যেমন আমার যন্ত্রণার রঙ, তোমার প্রতিটি রাত হোক দর্পণের মতো নিঃসঙ্গ, তুমি যাকে ভালোবাসবে, সে যেন তোমাকে দেখে নিজেকে খোয়ায়, তুমি যেন তার হৃদয়ে হয়ে ওঠো এক বিষণ্ন সংক্রমণ।”
আমি বললাম— “তুমি যেন প্রতিটি আয়নায় নিজের মুখে অন্য কারো ছায়া দেখো, যে ছায়া তোমাকে চেনে না, ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না। তোমার ঘুমে আসুক সেইসব মৃত কবিরা, যারা প্রেমের নামে কেবল যন্ত্রণায় জীবন্ত পুড়েছে।”
তারপর আমি হাঁটতে শুরু করলাম— চেনা শহর ছেড়ে, পরিচিত শব্দ ছেড়ে, নতুন এক পরাবাস্তব জগতে, যেখানে আমি কবি নই, আমি অভিশপ্ত প্রেমিকদের আত্মা।
এখন, এই পৃথিবীর কোনো বাতাস আমার গায়ে লাগে না, আমি আয়নায় নিজেকে দেখি না, আমি কেবল হেঁটে যাই— একটি অভিশাপ হয়ে, একটি দুর্যোগ হয়ে, একটি ঘূর্ণিঝড় হয়ে—
যার নাম রেখেছি ‘তুমি’।

Responses