নিজেদের বদলান, নয়তো জনগণই আপনাদের বদলিয়ে দিবে

লিটন হোসাইন জিহাদ: বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের যে ঢেউ আজ স্পষ্ট, তা আর কেবল সাময়িক উত্তালতা নয়; এটি গভীর সামাজিক রূপান্তরের বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘদিন ধরে এই দেশের রাজনীতি দুই-তিনটি বড় দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে আটকে থেকেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পরিবারতন্ত্র, ক্ষমতার উত্তরাধিকার, দুর্নীতি ও জবাবদিহির ঘাটতি সাধারণ নাগরিকের আস্থাকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার ও নীতিনির্ধারণের প্রক্রিয়া যখন কেবল রাজনৈতিক নাটকীয়তার অংশ হয়ে ওঠে, তখন ক্ষোভ ও হতাশা ধীরে ধীরে মূর্ত রূপ নেয়। এই ক্ষোভই এখন পরিবর্তনের অনিবার্য ঢেউয়ে রূপান্তরিত হয়েছে, যা প্রথাগত রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে।
এই রূপান্তরের পেছনে যে শক্তি সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, তা হলো নতুন প্রজন্ম—প্রযুক্তিনির্ভর জেন জেড। তারা বেড়ে উঠেছে এক ভিন্ন বাস্তবতায়: ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে। তাদের কাছে রাজনীতি আর অন্ধ আনুগত্যের বিষয় নয়; এটি একধরনের দায়িত্ববোধ, যেখানে যুক্তি, স্বচ্ছতা, মানবিকতা ও বৈশ্বিক মূল্যবোধের সমন্বয় অপরিহার্য। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকট, লিঙ্গসমতা, মানবাধিকার, সুশাসন—এসব প্রসঙ্গ তাদের রাজনৈতিক চেতনায় প্রতিনিয়ত স্থান করে নিচ্ছে। তাই তারা কেবল নিজেদের দেশ নয়, পৃথিবীর বৃহত্তর পরিসরের নাগরিক হিসেবে নিজেদের দেখতে অভ্যস্ত।
তাদের রাজনৈতিক আচরণও পূর্ববর্তী প্রজন্মের থেকে ভিন্ন। পুরনো ধাঁচের দলীয় ক্ষমতার লড়াই, ব্যক্তিপূজা কিংবা আবেগনির্ভর স্লোগান তাদের আর টানে না। তারা খুঁজে ফেরে নীতি ও ফলাফলের স্পষ্টতা। এই প্রজন্মে যে সামাজিক মাধ্যমের সক্রিয়তা রয়েছে, তা একদিকে দ্রুত জনমত গঠনের হাতিয়ার, অন্যদিকে রাজনীতিকদের জন্য দায়মুক্তির পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হওয়ার সতর্কবার্তা। কোনো অন্যায়, কোনো বৈষম্য বা দুর্নীতির খবর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং তৈরি করতে পারে তীব্র চাপ। এই নতুন বাস্তবতায় নেতাদের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আর কেবল নৈতিক দায় নয়, রাজনৈতিক বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও এই পরিবর্তনের আভাস বহন করছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে নাগরিক আন্দোলন, শ্রম অধিকার থেকে জলবায়ু ন্যায্যতা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তরুণদের উপস্থিতি আর কেবল সমর্থকের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ নয়, তারা নিজেই আন্দোলনের রূপকার। তারা রাজনীতিকে ক্ষমতার খেলা নয়, সেবামূলক ও নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের ক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চায়। ফলে দলগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের কৌশল বদলাতে বাধ্য হচ্ছে, যদিও এই পরিবর্তন সবক্ষেত্রে সমান গতিতে ঘটছে না।
তবে এই স্রোত কোনো বাধাহীন যাত্রা নয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব, ডিজিটাল বিভাজন, এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন নতুন প্রজন্মকে হতাশ করতে পারে। অনলাইনে মিথ্যা তথ্যের প্রসারও একটি বড় ঝুঁকি, যা প্রকৃত আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম। তবুও তারা শিখে ফেলেছে বিকল্প পথ খুঁজে নেওয়ার কৌশল; নতুন প্ল্যাটফর্ম, নতুন আঙ্গিক ও সৃজনশীল প্রতিবাদ তাদের শক্তি হয়ে উঠছে।
ফলে আজ যে সতর্কবাণী শোনা যাচ্ছে—“হয় নিজেকে বদলান, নয়তো জনগণই আপনাদের বদলিয়ে দিবে”—তা কেবল আবেগের চিৎকার নয়, সময়ের স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা। বাংলাদেশের তরুণরা আর ‘ভবিষ্যৎ’ নয়; তারা বর্তমানের চালিকাশক্তি। রাজনীতির মূল চরিত্র, নেতৃত্বের ধরন ও নীতি এখন তাদের চোখের সামনে পুনর্লিখিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার পথ না নেয়, যদি জনগণের প্রকৃত প্রত্যাশাকে অবহেলা করে, তবে জনগণই বিকল্প তৈরি করবে।
বাংলাদেশ আজ যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, সেখানে এই পরিবর্তনের ঢেউ কেবল সরকার বা দলের পালাবদল নয়; এটি রাজনীতির দর্শন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার চর্চার গভীরে এক মৌলিক রূপান্তরের সূচনা। নতুন প্রজন্মের মানসিকতা, তাদের নৈতিক ও প্রযুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছু মিলে এই পরিবর্তনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। যে নেতৃত্ব এই বার্তা বুঝবে না, তারা অবশ্যম্ভাবীভাবে ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাবে; আর যারা বুঝবে, তারা আগামী বাংলাদেশের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে।

Responses