হেমন্তের শুভ্র অতিথি: হেমশুভ্র প্রজাপতির গল্প

দিনটি ছিল পয়লা কার্তিক। মানে হেমন্তকাল শুরু হলো। হেমন্তের শুরু হয় কুয়াশা পড়া, হিম ঝরা ও কিছু গাছের পাতা ঝরার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া হেমন্তে ফোটে তুষারসাদা হিমঝুরি ফুল। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানটের প্রবেশপথে একটি হিমঝুরি ফুলের গাছ আছে। সেটিতে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে কি না, তা দেখতেই বেরিয়েছি।
ধানমন্ডি লেক পেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি গাছের গোড়ায় চোখ পড়ল। শুকনো পাতায় ভরে আছে গাছের তলা। সে পাতার ওপর বসে আছে একটি হেমশুভ্র প্রজাপতি। তার ডানা চারটি আকাশমুখী করে ভাঁজ করা। তাই ডানার তলাটি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ডানার ওপরটা কেমন, তা দেখার উপায় নেই।
প্রজাপতিরা যেমন রংবাহারি চটকদার হয়, তেমন হেমশুভ্র না। হিম হিম সাদা ডানার কারণেই হয়তো এই প্রজাপতির বাংলা নাম রাখা হয়েছে হেমশুভ্র। তবে পশ্চিমবঙ্গে এর নাম ফুরুস। ফুরুস নামটি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়।
বাংলাদেশে ওকে আমরা হেমশুভ্র নামেই চিনি। তবে প্রজাতিগত নামেই এই প্রজাপতি দুই দেশেই পরিচিত। এ প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম লেপ্টোসিয়া নিনা (Leptosia nina)। গোত্র পিয়েরিডি।
হেমশুভ্র ছোট আকারের প্রজাপতি। এর দেহ ও ডানা রেশমি সাদা। ডানায় থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো ফুটকি দাগ ও ঢেউ একে আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। ডানা মেললে ওপরের মাঝ-আঁচলে একটি বড় কালো ফুটকি দাগ দেখা যায়। অবশ্য এর ডানার শীর্ষপ্রান্ত কালো।
এসব দাগ ডানার তলা থেকে দেখা যায় না। প্রসারিত অবস্থায় ডানার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের বিস্তার হয় ২০ থেকে ৫০ মিলিমিটার। ডানার নিচের পিঠ ধুলোটে সাদা বর্ণের। পেছনের ডানার নিচে সূক্ষ্ম-সবুজাভ বা পীতরঙা দাগ দেখা যায়।
হেমশুভ্র প্রজাপতি এ দেশের সব জায়গায় দেখা যায়। এরা খুব কম সময়ের জন্য বিশ্রাম নেয়। তাই এদের সব সময় উড়তে দেখা যায়। ওড়ার ধরন খুব দুর্বল। এরা থেমে থেমে উড়ে বেড়ায়। এরা মাটি থেকে দুই ফুটের বেশি ওপরে ওড়ে না।
শুকনো ডালপালা ও পাতার ওপর বসতে বা বিশ্রাম নিতে এরা ভালোবাসে। অনেকটা প্রয়োজনেই ওরা সেটি করে। কেননা অনেক শুকনো পাতার সঙ্গে ওদের গায়ের রং প্রায় মিলে যায়। এটি যেন ওদের একধরনের ছদ্মবেশী ভাব। এর ফলে তারা শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পায়।
কয়েক দিন আগে ধানমন্ডির ফরাসি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনের বাগানে হলদে ভূমিজ অর্কিড ফুলে একটি হেমশুভ্রকে ঘুরতে দেখেছিলাম। কিন্তু থিতু হয়ে না বসায় তার ছবি তোলা যায়নি। হুরহুরে, বরুণ বা বন্যা ও আষাঢ়ীলতা ফুল এদের খুব পছন্দ।
এ ছাড়া মধুর সন্ধানে এরা আরও অনেক বুনো ফুলে ঘুরে বেড়ায়। প্রধানত ঘাসবন, লতাপাতা ও ঝোপঝাড় এদের আবাসস্থল। মধু খেতে, মিলনে যেতে ও ডিম পাড়তে এরা ঘুরে বেড়ায়। এরা জঙ্গলে থাকতেই বেশি ভালোবাসে।
মেয়ে হেমশুভ্র পাতার ওপরে টাকু আকারের ফ্যাকাশে নীলচে-সবুজ ডিম পাড়ে। ডিমের গায়ে খাঁজকাটা থাকে। ডিম ফুটে কিড়া বা বাচ্চা বের হয়। বাচ্চারা দেখতে গাঢ় সবুজ রঙের হওয়ায় ওরাও সবুজ পাতার সঙ্গে মিশে থাকে। এটি যেন বাচ্চাদের একধরনের ছদ্মবেশ।
কিড়ার পিঠের ওপর লম্বালম্বিভাবে গাঢ় রঙের সবুজ রেখা থাকে। আর পিঠের দুই পাশে থাকে সাদাটে রেখা, এর ওপরে থাকে একটি অস্পষ্ট কালো রেখা। কিড়াগুলো ডিম ফুটে বেরিয়ে বরুণ, আষাঢ়ীলতা, কণ্টকলতা, ক্লেওম বা হুরহুর ইত্যাদি গাছের পাতার সবুজ অংশ খাওয়া শুরু করে। খেতে খেতে কিড়াগুলো বড় হয়।
এর শেষ দিকে কিড়াগুলো নিষ্ক্রিয় অবস্থায় একটি খোলসের মধ্যে লম্বা ঘুম দেয়। ঘুম দেওয়ার আগে পাতার নিচে বা ডালপাতার ঝোপের ভেতর খোলসটা আটকে রাখে।
পুতুলের মতো দেখতে সেই মূককীট বা পিউপার রংও হয় সবুজ। এটি মাঝে মাঝে বাদামি রঙেরও হয়। খোলসের ওপর কালচে খয়েরি ফোঁটা দেখা যায়। এদের জীবনচক্র শেষ হয় ১৭ থেকে ২০ দিনে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ফিলিপিন্স, চীন ইত্যাদি দেশে এদের দেখা যায়। এ দেশে হেমশুভ্র মোটেই বিরল প্রজাপতি না। আপাতত ওদের নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই।
ওদের বাচ্চারা গাছের পাতা খেয়ে ক্ষতি করলেও হেমশুভ্র বিভিন্ন গাছে ফুলের মধু খাওয়ার সময় পরাগায়নে সাহায্য করে। এ কারণে সেসব গাছের ফল ও বীজ হয়। এর মাধ্যমে ওই সব গাছের বংশরক্ষা হয়। কাজেই হেমশুভ্র প্রজাপতি উদ্ভিদের ক্ষতির চেয়ে উপকারই বেশি করে।

Responses