নিসর্গে তুমি : লিটন হোসাইন জিহাদ

রাত্রির অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো ধীরে ধীরে গ্রামটাকে জাগিয়ে তুলছিল। চারপাশে একরাশ কুয়াশা, যেন প্রকৃতি নিজের শরীর জড়িয়ে রেখেছে শুভ্র চাদরে। বটগাছের পাতায় শিশিরের ঝিকিমিকি, পাখিরা ডানা মেলছে নতুন দিনের গান গাওয়ার আশায়। এমন ভোরে শহরফেরা নির্ময় হাঁটছে ধানক্ষেতের আল ধরে।
সে এসেছে এখানে তার দাদাবাড়িতে, বহু বছর পর। শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে, নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজতে। কবিতা আর নিঃসঙ্গতার এক কাব্যিক যাত্রী সে। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছে, কিন্তু ভালোবাসা… সে এখনো অধরা।
নদীর পাশের সেই ছোট্ট বাঁকের কাছেই নির্ময় প্রথম দেখে তাকে।
সে – অর্ণা।
সাদা শাড়িতে, কাঁধে একটি ছোট ঝুড়ি। চুল খোলা, চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। সে ঝুঁকে ফুল তুলছে ঘাসের মধ্যে থেকে, যেন প্রকৃতিই তার হাতে ধরা দিচ্ছে। নির্ময়ের পা হঠাৎ থেমে যায়। সে যেন কোনো চিত্রকরের ক্যানভাসে আটকে গেছে।
অর্ণা হঠাৎ পেছনে ঘুরে তাকায়।
দৃষ্টি বিনিময় হয়। এক মুহূর্তে সময় যেন থমকে দাঁড়ায়।
— “আপনি কি আমার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে আছেন?”
— “হ্যাঁ, প্রকৃতিকে দেখছিলাম, আপনি তো তারই একটা অংশ।”
অর্ণা হেসে ওঠে। সে হাসি ছিলো না মানুষের, যেন পাখির হাসি। নির্ময় জীবনে এত স্বচ্ছ, মুক্ত হাসি কখনো শোনেনি।
— “আপনি শহরের মানুষ, না?”
— “হ্যাঁ, কিন্তু নিজেকে প্রকৃতির মানুষ ভাবতেই ভালো লাগে। এখানে এসেছি একটু নিঃশ্বাস নিতে।”
— “তাহলে আপনি সঠিক জায়গায় এসেছেন,” বলে সে, আরেকটা ফুল তার ঝুড়িতে রাখে।
কিছুক্ষণ তারা হাঁটে। অর্ণা ফুল চিনিয়ে দেয় — চামেলি, গাঁদা, শিউলি। নির্ময় শুনতে শুনতে ভুলে যায় সকাল হয়ে গেছে। পাখিদের ডাক, দিগন্তে ওঠা সূর্য, আর পাশে হেঁটে চলা এই মেয়ে — সবকিছু মিলিয়ে যেন কবিতার এক পঙ্ক্তির মতো হয়ে উঠছে এই সকাল।
— “আপনার নাম?”
— “নির্ময়। আপনার?”
— “অর্ণা। আমি এই নদীর মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই এর স্রোতের সঙ্গে বড় হয়েছি।”
নির্ময়ের মনে হলো, এই নদী, এই আলো, এই হাওয়া — সবই যেন অর্ণাকে গড়ে তুলেছে। সে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, “এত সুন্দর করে কেউ হেঁটে যেতে পারে?”
যেদিকে সে চলে যায়, যেন বাতাসও পিছনে পিছনে চলে।
অর্ণা বিদায় জানিয়ে চলে যায় বাঁশঝাড়ের পথে। নির্ময় তার চলার দৃষ্টিপথে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। কুয়াশা আস্তে আস্তে গায়েব হয়, কিন্তু নির্ময়ের চোখে জমে থাকে এক নতুন রঙের আলো।
সে জানে না, এই মেয়েটি তার জীবনে কী নিয়ে আসবে — প্রেম, না ব্যথা। কিন্তু সে এটুকু জানে — এই সকালে সে ভালোবেসে ফেলেছে একজনকে, যার নাম অর্ণা।
পর্ব: ২
সকালের সেই পরিচয়ের পর থেকে অর্ণা ও নির্ময়ের দেখা প্রায় প্রতিদিনই হতে লাগল। কখনো পুকুরপাড়ে, কখনো ধানক্ষেতের আলে, আবার কখনো গোধূলি বেলায় নদীর পাড়ে। তাদের আলাপ যেন গাছের পাতার মতো ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছিল—একেকটা প্রশ্ন, একেকটা হাসি, একেকটা কবিতা… একেকটা পাতা।
এক দুপুরে, চৈত্রের খর রোদ মাথায় নিয়ে অর্ণা বলল—
— “আজ তোমায় আমার প্রিয় জায়গাটা দেখাব।”
নির্ময় হাঁসলো।
— “তুমি বললেই যাই। রোদ যেমনই থাক, পাশে তুমি থাকলেই সব ঠাণ্ডা লাগে।”
তারা হাঁটতে লাগল বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে। পাখিরা ডাকছিল দূরে, কোথাও একঝাঁক প্রজাপতি ওড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল হাওয়ার মাঝে। তারা এক সময় গিয়ে দাঁড়াল এক ঢালু মাঠে, যেখান থেকে দিগন্ত দেখা যায়।
— “এই জায়গায় এসে আমি প্রতিদিন বসি। ছায়ায় বসে হাওয়া শুনি, মাটির গন্ধ নিই। এখানেই আমার সবচেয়ে নিজের মতো লাগে।”
নির্ময়ও বসে পড়ে। বাতাসে তার চুল উড়ে যাচ্ছে, অর্ণার চোখে সেই দৃশ্যের প্রতিফলন পড়ে।
— “তুমি কি সবকিছুকে এত গভীরভাবে দেখো?”
— “আমি কবি, অর্ণা। আমার দেখা মানেই শুধু চোখ দিয়ে নয়। আমি অনুভব করি।”
অর্ণা হেসে উঠে পাশে বসে। গলায় ওড়না পড়ে গেছে খোলা ঘাসে। নির্ময় সেটা তুলে দেয়। তাদের আঙুল ছুঁয়ে যায় এক মুহূর্তের জন্য। স্পর্শটা ছোট, কিন্তু যেন একটা রেশ রেখে যায় হৃদয়ের গহীনে।
নির্ময়ের চোখ পড়ে অর্ণার কাঁধে—এক পুরনো দাগ।
সে কিছু জিজ্ঞেস করে না, কিন্তু অর্ণা নিজেই বলে ওঠে—
— “ছোটবেলায় একবার আগুন লেগেছিল ঘরে। আমি বোনকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে যাই। মা সেই আগুনেই… হারিয়ে যান।”
নির্ময়ের বুক কেঁপে ওঠে।
— “তোমার ভেতর এত আলো, অথচ কতো অন্ধকার পেরিয়ে এসেছো!”
— “আলো না থাকলে তো আঁধার এত স্পষ্ট হতো না,” অর্ণা ধীরে বলে।
এই কথায় নির্ময় আরও আকৃষ্ট হয়। সে অনুভব করে, সে কেবল অর্ণার রূপে নয়, তার গভীরতায় ভালোবেসে ফেলেছে।
এক দুপুর তারা হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যায়। মেঘ ছিল না, কিন্তু এক ঝাপসা, হঠাৎ আসা বর্ষা নামে মাঠে। অর্ণা দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ায়, হেসে বলে—
— “এই বৃষ্টি আমাকে মনে করায়, জীবনে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। সুখ আসবে হঠাৎ করে, ঠিক এই বৃষ্টির মতো।”
নির্ময় তাকিয়ে থাকে—একজন নারী, যাকে বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে, যার চোখে আনন্দ, শরীরে রূপ, আর মনের গভীরে একটা অতল প্রেম।
সে হঠাৎ করে বলে ফেলে—
— “অর্ণা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
অর্ণা একটু থামে, তাকায়।
তার চোখে ভয়, বিস্ময়, আর এক চিলতে আনন্দ।
— “তুমি জানো না, নির্ময়… আমার জীবনে ভালোবাসা মানে জটিলতা। আমি মুক্ত আকাশের পাখি, আর তুমি… তুমি আমার গাছের শিকড়ের মতো। তুমি চাও আমাকে ধরে রাখতে, আর আমি… উড়তে চাই। তুমি পারবে?”
নির্ময় চুপ করে। সে বোঝে, এই প্রেম সহজ হবে না। কিন্তু তার হৃদয় বলে—
— “যদি তুমি উড়ো, আমি আকাশ হবো। যদি তুমি হারিয়ে যাও, আমি অপেক্ষা করবো নদীর তীরে। শুধু কথা দাও, কখনো একেবারে চলে যেও না।”
অর্ণা কিছু বলে না। কেবল হেঁটে চলে যায় কুয়াশা ভেজা বৃষ্টির মধ্যে, গাছের পাতার ফাঁকে রোদ আর জলের খেলা যেমন হয়।
নির্ময় দাঁড়িয়ে থাকে।
এই প্রেম—সে জানে—কবিতার মতোই হবে। হয়তো পাওয়া হবে না, তবুও রচতে হবে তাকে, প্রতিদিন।
পর্ব-৩
গোধূলি নেমে এসেছে। সূর্য একদিকে নেমে যাচ্ছে, অন্যদিকে আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে কমলা আর হালকা বেগুনি আলো। পাখিরা নীড়ে ফিরছে, বাতাসে একটা বিষণ্ণ সুর।
নির্ময় দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরোনো বাঁশঝাড়ের নিচে। তার চোখ পেরিয়ে যাচ্ছে নদীর ওপারে, যেখানে অর্ণা হেঁটে আসছে ধীরে ধীরে। সাদা জামা, নীল ওড়না—এক ধরনের শান্ত সৌন্দর্য, যেন সে প্রকৃতিরই পাঠশালা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
— “তুমি তো বলেছিলে একদিন, যদি আমি উড়ি, তুমি আকাশ হবে।”
অর্ণা বলে।
— “হ্যাঁ, আজও বলি,” নির্ময়ের কণ্ঠ স্থির।
অর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে—
— “তবে আজ আমি বলবো—আমি তোমাকে ভালোবাসি। পুরোটা মন দিয়ে। তবে তোমার ভালোবাসায় আমি ভয় পাই।”
নির্ময় বিস্মিত হয়।
— “ভয় কেন?”
— “কারণ তুমি চাও আমাকে আগাগোড়া। আর আমি জানি, আমার কিছু অংশ আজও অন্য কোথাও আটকে আছে—আমার অতীতে, সমাজের ভয়ে… আমি সবটুকু হয়ে উঠিনি আজও।”
নির্ময় চুপ। চোখে জল এসে পড়ে। সে এগিয়ে গিয়ে অর্ণার কাঁধে হাত রাখে।
— “ভালোবাসা কোনো বাঁধা নয়, অর্ণা। এটা আশ্রয়।”
অর্ণা হেসে ফেলে, কিন্তু সেই হাসিতে বিষাদ মেশানো।
— “তুমি কবিতা লেখো, নির্ময়। তাই ভালোবাসাকে এত সহজ করে বলো। কিন্তু বাস্তবতা জানে না কবিতা।”
এক পলক চুপচাপ বসে থাকে তারা। দূরে বাঁশপাতা নড়ে, জোনাকির আলো ফুটি ফুটি করে জ্বলতে শুরু করেছে।
অর্ণা ধীরে বলে—
— “আমার এক আপনজনের হার্টের অপারেশন। শহরে যেতে হবে। থাকতে হবে কিছুদিন। আমি ঠিক জানি না কবে ফিরবো। বা আদৌ ফিরবো কিনা।”
নির্ময়ের বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। সে বহুদিন ধরে যা ভয় পাচ্ছিল, তা যেন আজ সত্যি হলো।
— “তোমার চলে যাওয়া মানে আমার হেরে যাওয়া। তুমি যদি না থাকো, কবিতার ভাষা শুকিয়ে যাবে আমার।”
অর্ণা চোখে চোখ রাখে।
— “তোমার কবিতা আমাকেই ধরে রাখুক। তুমি লিখো আমার জন্য, নির্ময়। যদি তোমার কলম আমার নাম ভুলে না যায়, আমি একদিন ফিরবো। যদি প্রকৃতি আমাকে ফিরিয়ে আনে।”
অর্ণা চলে যায়। নির্ময় দাঁড়িয়ে থাকে বৃষ্টির মতো নীরব সন্ধ্যায়। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, নদী বইছে, আকাশে চাঁদ উঠেছে—কিন্তু তার বুকের ভিতর এক বিষণ্ন নীরবতা।
তার জীবনের সবচেয়ে আলো ঝলমলে সন্ধ্যাটি শেষ হয়ে গেল এক অন্ধকার বার্তার মধ্যে।
সেই রাতে সে লিখে—
“তুমি চলে যাও, আমি তোমার পায়ের শব্দ শুনে
নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকবো।
তুমি ফিরলে, বাতাস বলবে আমায়,
আর আমি কবিতা হয়ে বসে থাকবো তোমার অপেক্ষায়।”
পর্ব- ৪
রাত গভীর হয়। চারপাশে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। বটগাছের পাতা আর নড়ে না, কুয়াশা নদীর ওপার ঢেকে রাখে। জোনাকির আলো ফুরিয়ে গেছে।
নির্ময় এখন একা।
অর্ণা চলে যাওয়ার পর সে আর কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে না। গ্রামের মানুষ ভাবে, শহরের ছেলে হয়তো মন কষেছে গ্রামীণ জীবনের একঘেয়েমিতে। কেউ জানে না, তার ভেতর প্রতিদিন জ্বলছে এক নিঃশব্দ আগুন—অর্ণার স্মৃতি।
তার ঘরজুড়ে ছড়িয়ে অর্ণার ছোঁয়া—একটা শুকনো ফুল, অর্ধেক লেখা কবিতা, নদীর পাড়ে পাওয়া পাথর। প্রতিটি বস্তু একেকটি পেইনটিং-এর মতো মনে করিয়ে দেয় তার অনুপস্থিতি।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে যায় সেই ঢালু মাঠে। চুপ করে বসে। তার পকেটে থাকে ডায়েরি, কলম।
সে লিখে,
“তুমি কি সুখে আছো অর্ণা?
তোমার আঙুলে কি অন্য কারো হাত জড়িয়ে আছে এখন?
তোমার চোখে কি আমি একফোঁটা আবছা ছায়া হয়েও রইলাম?”
প্রতিটা দিন সে ভাবে, অর্ণা একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু সময় যায়, মৌসুম বদলায়। গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে, শিউলি ঝরে পড়ে।
তবুও সে অপেক্ষা করে।
একদিন নদীর পাড়ে সে শোনে গ্রামের রথেশ কাকা বলছে—
— “ও অর্ণা? শুনেছি শহরে আবার বিয়ে করেছে। এক ডাক্তার সাহেব নাকি। ভালোই আছে সে।
নির্ময়ের বুকের ভিতর হাহাকার ওঠে। সে চুপ থাকে। কথা বলে না, প্রশ্ন করে না। শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন জলের ঢেউ কিছু উত্তর দেবে তাকে।
সেই রাতে সে বসে কবিতা লেখে না। সে চুপ করে আকাশের দিকে তাকায়।
তার মনে পড়ে, অর্ণা বলেছিল—
“ভালোবাসা মানে মুক্তি, না বন্ধন?”
সেই প্রশ্নের উত্তর আজও তার কাছে নেই। কিন্তু সে জানে—
ভালোবাসা তার ভেতর থেকে যায়, চিরকাল। না পাওয়া ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি স্থায়ী।
সে ভাবে,
“যদি অর্ণা আজ সত্যিই অন্য কারো হাত ধরে থাকে, তবুও আমি তাকে দোষ দিই না।
সে যেভাবে ভালোবেসেছিল, ততটা পায়নি কোনোদিন হয়তো। আমি শুধু কবিতায় তাকে বাঁচিয়ে রাখলাম।”
রাত আরও গভীর হয়।
নির্ময় তার বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখের কোণে জল জমে। ঘরের বাতাসে এখনও হালকা চামেলি ফুলের গন্ধ—যেটা অর্ণা দিয়েছিল এক দুপুরে।
শেষবার সে ডায়েরি খুলে লেখে—
“আমি অপেক্ষা করি না আর।
আমি এখন শুধু লিখি,
কারণ তুমি আমার জীবনে প্রেম ছিলে,
আর আমি তোমার জীবনে বিরহ।”
বাইরে পূর্ণিমা চাঁদ উঠেছে।
হৃদয়ে প্রেম এসেছিল ধীরে, কুয়াশার মতো। সে জমেছিল দুপুরের উত্তাপে, ভিজেছিল বৃষ্টিতে, এবং হারিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার আলোছায়ায়। কিন্তু প্রেমের স্মৃতি, প্রেমের কবিতা—এরা কখনো হারায় না। তারা বেঁচে থাকে… ঠিক নির্ময়ের মতো।
Responses