দোয়েল চত্বরে ঐতিহ্যের মেলা: মৃৎশিল্প, কারুশিল্প আর বাঙালির সৌখিনতার রঙে সেজে থাকা রাজধানীর এক শিল্পরাজ্য

শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যের ধারক হয়ে বাঙালির জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নানান হস্তশিল্প। আবহমান বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি জীবনবোধের সঙ্গে মিশে আছে মৃৎশিল্প, কারুশিল্প বেতশিল্পের অসাধারণ সব নিদর্শন।

এসব কুটির শিল্প শুধু গ্রামীণ নারীর সৌখিনতার প্রতীক নয়, বরং বাঙালির নান্দনিকতা, শিকড় জীবনযাপনের অংশ।

 

 

এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প এখন গ্রাম ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে শহরের অন্দরমহলেরাজধানীর দোয়েল চত্বর তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ।

ঢাকার দোয়েল চত্বর এখন হস্তশিল্পপ্রেমীদের এক মিলনমেলা। সারি সারি দোকানে সাজানো থাকে মাটির, কাঠের, পাটের, বেতের, পিতলের আর কাঁসার তৈরি অনন্য সব শিল্পকর্ম। প্রতিটি পণ্য যেন গল্প বলে বাঙালির ঐতিহ্যের, গ্রামীণ জীবনের সরল সৌন্দর্যের।

দোকানগুলোর সামনে সারি সারি টেরাকোটার দেয়াল ঝুলানো, রঙিন মাটির হাঁড়িকলস, কাঠের খোদাই করা শোপিস, গহনার বাক্স, টেবিল ল্যাম্প, পাটের ব্যাগ, পুতুল আর নানা ধরনের গহনা। সব মিলিয়ে পুরো এলাকা যেন এক জীবন্ত শিল্পরাজ্য, যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার চমৎকার সংমিশ্রণ ঘটেছে।

শহুরে মানুষ এখন ঘর সাজানোর পাশাপাশি জীবনের অংশ হিসেবেও গ্রহণ করছে এসব শিল্পপণ্য। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস বা অন্য যেকোনো উৎসবেই দেখা যায় দোয়েল চত্বরে মানুষের ভিড়।

বিশেষ করে নববর্ষের সময় মাটির তৈরি গহনা, মুখোশ, শোপিস, বাঁশবেতের সামগ্রী, কাঠের টেরাকোটা ফ্রেমসবকিছুর বিক্রি বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

বিগত কয়েক দশক ধরে এখানকার দোকানগুলো ঐতিহ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অনেক দোকানি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ব্যবসা করছেন। কেউ মৃৎশিল্প নিয়ে আসেন পটুয়াখালী, রাজশাহী বা কুমিল্লা থেকে; কেউ বেত পাটের সামগ্রী বানান নরসিংদী বা টাঙ্গাইল থেকে।

সব মিলিয়ে দোয়েল চত্বর যেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পীদের মিলনস্থলযেখানে দেশের প্রতিটি কোণের হস্তশিল্প একত্র হয়ে তৈরি করে এক রঙিন সংস্কৃতির মেলবন্ধন।

শুধু দেশীয় ক্রেতা নয়, এখানে আসেন বিদেশি পর্যটকরাও। তারা আগ্রহভরে কিনে নেন মাটির তৈরি ঐতিহ্যবাহী হাঁড়ি, ফুলদানি, হাতের কাজের পুতুল, কাঠের গহনা কিংবা পাটের ব্যাগ। এসব পণ্য তাদের কাছে কেবল স্মারক নয়বাংলার সংস্কৃতির একটি টুকরো।

দোয়েল চত্বরের রাস্তায় হাঁটলে মনে হয়, শহরের কোলাহলের মাঝেও যেন গ্রামীণ বাংলার গন্ধ ছড়িয়ে আছে। মাটির গন্ধ, রঙিন টেরাকোটার কাজ, কাঠের খোদাই আর পাটের কোমল স্পর্শসব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে শহুরে মানুষদের জন্য এক অনন্য সৌখিনতার রাজ্য।

আজকের ব্যস্ত নাগরিক জীবনে দোয়েল চত্বর কেবল কেনাকাটার স্থান নয়, বরং এটি এক সংস্কৃতি কেন্দ্রযেখানে ঐতিহ্য, শিল্প, সৃজনশীলতা বাঙালিয়ানার গর্ব একসূত্রে গাঁথা। এখানকার প্রতিটি দোকান, প্রতিটি পণ্য বাঙালির শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, শেখায়যত আধুনিকতাই আসুক, ঐতিহ্যই আমাদের পরিচয়ের সবচেয়ে বড় অংশ।

দোয়েল চত্বর তাই শুধু একটি মোড় নয়এটি বাঙালির সৃষ্টিশীলতা, ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যবোধের জীবন্ত প্রতীক।

Related Articles

নিসর্গে তুমি : লিটন হোসাইন জিহাদ

রাত্রির অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো ধীরে ধীরে গ্রামটাকে জাগিয়ে তুলছিল। চারপাশে একরাশ কুয়াশা, যেন প্রকৃতি নিজের শরীর জড়িয়ে রেখেছে শুভ্র চাদরে। বটগাছের পাতায় শিশিরের ঝিকিমিকি,…

পুর্নজন্ম কি বৈজ্ঞানিক ভাবে সম্ভব? — একটি বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ

মানব ইতিহাস জুড়ে মানুষের মৃত্যু ও মৃত্যুর পর কী হয়—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য বহু ধর্ম, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা চেষ্টা করেছে। অতীতে জীবনের পরের ধাপে…

প্রকৃতির টানে, সবুজের পথে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুরু হলো দশ দিনব্যাপী বৃক্ষমেলা ২০২৫

পরিবেশ সচেতনতার মহোৎসব নগরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট, ধুলোবালি আর কংক্রিটের জঞ্জালে ঢাকা জনজীবনে যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে, তখনই সবুজের নবদিগন্ত উন্মোচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের…

প্রকৃতির টানে, সবুজের পথে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুরু হলো দশ দিনব্যাপী বৃক্ষমেলা ২০২৫

পরিবেশ সচেতনতার মহোৎসব নগরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট, ধুলোবালি আর কংক্রিটের জঞ্জালে ঢাকা জনজীবনে যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে, তখনই সবুজের নবদিগন্ত উন্মোচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের…

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুরু হলো দশ দিনব্যাপী বৃক্ষমেলা ২০২৫, পরিবেশ সচেতনতার মহোৎসব

নগরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট, ধুলোবালি আর কংক্রিটের জঞ্জালে ঢাকা জনজীবনে যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে, তখনই সবুজের নবদিগন্ত উন্মোচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে শুরু হয়েছে…

Responses